সে সারাদিন ধরে রাতের প্রস্তুতি নিত। প্রদীপের সলতেগুলো পাকাতো বসে বসে। রোদ উঠলে গাছের তলায়, আর মেঘলা থাকলে উঠানে বসে। হারিকেনে তেল ভরত, কাঁচগুলো ঘষেমেজে রাখত ঝকঝকে।
রাতে ঝড় উঠলে কি হবে ভেবে দরজার খিলগুলো রোজ নেড়েচেড়ে দেখত। ছাদের উপর টালিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত। গাছের দুর্বল ডাল টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিত।
একদিন এক সাধু এলো তার বাড়ি ভিক্ষা করতে। ভিক্ষা চাইল, দুটো ভিক্ষা পাই গো বাবা!
কিন্তু সে সলতে বানাতে এত মগ্ন, শুনতেই পেলো না। সাধু বার কয়েক ডেকে ফেরার পথে পা বাড়ালো। সাধুর পা পড়ল গিয়ে খিল বানানোর কাঠে। মচ্ করে আওয়াজ হল। অমনি সলতে বানানো ছেড়ে তাকিয়ে বলল, আপনি?
সাধু বলল, বাবা দুটো ভিক্ষা চাইতে এসেছিলাম… তা তুমি সলতে বানাতে এত মগ্ন যে….
আসলে দেখুন মানুষের আসল ভয়ের সময় কখন? রাত্রি…. তাই তার প্রস্তুতি… এহে.. হে.. আপনি তো নতুন খিলের কাঠটা ভেঙে দিলেন দেখছি..
সাধু তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, তোমার মনে সকাল হয় না? সারাদিন বুঝি রাতই থাকে?
সে বলল, আমি অতশত শাস্ত্রের কথা জানি না বাপু… মনে সকাল মানে কি? রাতই বা মানে কি?
সাধু বলল, মনে সকাল হবে, তার জন্য প্রস্তুতি নিলে কই? তুমি তো দেখছি রাত্রিতেই বুঁদ হয়ে গো… এতবড় দিনের মধ্যে কি কিছুই নেই?
সে বলল, কেন থাকবে না? দিনই রাতের জন্য সলতে পাকানোর সময়… যেমন যৌবন বার্ধক্যের জন্য অর্থ… অবশ্য আপনি এ সব থেকে পালিয়েছেন….
সাধু বলল, পালাচ্ছি আমি না তুমি সে হিসাব পরে হবে… এখন বলো তো, সকালের জন্য প্রস্তুতি নেবে কবে?
সে বলল, সকালের জন্য প্রস্তুতি নেয় কি করে?
সাধু বলল, আলোতে বিশ্বাস রেখে….
সে বলল, আলো আমার বিশ্বাসের অপেক্ষা রাখে? সে এমনিই আসে…
সাধু বলল, দাওয়ায় আসে… মনে আসে কই?
সে বলল, মনে আসার রাস্তা কি?
সাধু বলল, সব প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পণে….
সে বলল, তোমার কথায় আমার ভয় লাগছে… তুমি যাও…
সাধু বলল, ভয়ের অন্ধকার থেকে বাঁচতে প্রদীপ জ্বালাবে না? সলতে পাকাবে না?
সে বলল, তুমি যাও… যাও…. যাও…
সাধু চলে গেল।
সে সব সলতে বুকে আগলে বসে থাকল চোখদুটো বন্ধ করে। অন্ধকার ঘিরে ধরল তাকে ধীরে ধীরে। ঘরের ভিতর থেকে চামচিকে, বাদুড় বেরিয়ে এলো।
সে মনে মনে বলতে লাগল… অন্ধকার নেই… হাজার হাজার সলতে আছে…. আছে হ্যারিকেন.. সেরকম হলে জ্বালাব মশাল… তাও না হলে জ্বালাব বাড়িটাই… তাও না হলে নিজেকেই…. তবু অন্ধকারের কাছে হারব না….
রাতের আকাশে একটা একটা তারা উঠেছে ফুটে। সে জানল না। জোনাকি তার বাড়ির আশেপাশে সংসার পেতেছে সেই কবে… সে জানল না….. সবাই তাকে বলল, তোমার মনে সকাল হবে কবে…
সে শুনতেই পেল না।