সন্ন্যাসী মুখে চোখে জল দিলেন। পাহাড়ি নদী। নির্জন। জঙ্গল আশেপাশে। রোদের আলোয় পিঠ দিয়ে পাথরের উপর বসলেন।
সামনের জঙ্গলে একজন অশরীরী অতৃপ্ত আত্মা থাকত। সে সন্ন্যাসীকে একা বসে থাকতে দেখে তার কাছে এলো।
সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু বলবে?
আত্মা জিজ্ঞাসা করল, আমি সারাটা জীবন বেঁচে ঠিক করতে পারলাম না, সুখ কি? আপনি কিছু জেনেছেন?
সন্ন্যাসী চুপ করে রইলেন। আত্মা অস্থির হয়ে আবার প্রশ্ন করল, আপনি কি জেনেছেন, সুখ কি?
সন্ন্যাসী এবারেও চুপ। নদীর জলের আওয়াজ, নানা পাখির ডাক - এইসব আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
আত্মা আবার জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি আমায় অযোগ্য ভাবছেন উত্তরের? সে আপনি ভাবতেও পারেন, সারা জীবন আমার খুব পুণ্যে তো কাটেনি...তবু আপনি সমদর্শী হবেন এই আশাতেই এসেছিলাম। আপনি যখন নিরুত্তর রইলেন আমি চলেই যাচ্ছি। আমার প্রণাম যদি গ্রহণযোগ্য মনে করেন, তবে নেবেন।
আত্মা ফিরে গেল।
বহুকাল হল। একদিন আত্মা সেই পাথরের উপর বসা এক বৃদ্ধকে দেখল, উদাস। একটু পরে সে বৃদ্ধকে পাহাড়ি নদীর ধারের দিকে যেতে লাগল। আত্মা বুঝল সে কেন যাচ্ছে, বহুকাল আগে সেও এই একই ভাবে.....
আত্মা সে বৃদ্ধের কাছে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল, বলল, কেন নিজেকে শেষ করতে যাচ্ছেন?
বৃদ্ধ বলল, সব মিথ্যা...অর্থহীন আমার কাছে...তুমি তো মরেছ...তুমি কি বুঝেছ এসবের অর্থ কি আসলে?....
আত্মা বলল, না আমিও বুঝিনি, তবু মরবেন না, আসুন আমরা দুজনে ওই পাথরের উপর বসি। বহুকাল আগে এক সন্ন্যাসী এসে বসেছিলেন, আমিও তাকে একই প্রশ্ন করেছিলাম।
বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, কি উত্তর দিয়েছিলেন?
আত্মা নিরুত্তর রইল। তারা দুজনে এসে পাথরের উপর বসল। ক্রমে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল। আকাশ জুড়ে একে একে তারা ফুটল। আত্মা আর বৃদ্ধ নীরব। শব্দ বলতে শুধু নিরন্তর বয়ে চলা পাহাড়ি নদীর ধারা।
হঠাৎ আত্মার কল্পলোকে ভেসে উঠল নীরব সৌম্য শান্ত সে সন্ন্যাসীর মুখ। দেখতে পেল সেদিনের ছবি আবার - সে বারবার প্রশ্ন করছে, সন্ন্যাসী উত্তর দিচ্ছেন না, সে অস্থির হচ্ছে।
আজ তার চেতনায় কি আলো জ্বলে উঠল! সেদিন সে বোঝেনি, সেই নীরবতাই ছিল উত্তর! তার সেই নিস্তব্ধতাই ছিল সুখের অর্থ। সেদিন তিনি তার প্রশ্নের উত্তরই দিচ্ছিলেন। সে বোঝেনি। আত্মার প্রাণে যুগান্তরের শান্তি নেমে এলো।
আত্মা বৃদ্ধকে বলল, আমি বুঝেছি...
কিন্তু সে বৃদ্ধ কই? এক টুকরো গেরুয়া কাপড় পড়ে পাথরের উপর।