টোটোটা রেখে বাড়ি ঢুকল। স্নান করল। গরম জলে। এখনও অল্প অল্প ঠাণ্ডা। ভাত খেল। ডাল, আলুসেদ্ধ আর আধখানা পেঁয়াজ দিয়ে। তার পাশে বসে খেল তার বউ। চুড়ির আওয়াজ হল। গ্লাস রাখার আওয়াজ হল। চিবানোর আওয়াজ হল। কথা হল। অল্প অল্প হাসি হল।
খাওয়া শেষ।
দু’জনে মুখ ধুলো বালতিতে রাখা জলে মগ ডুবিয়ে। দাঁতটা কনকন করল। বউ
বলল, দুদিন সরষের তেল আর নুন দিয়ে দাঁত মাজো।
বিছানায় এসে
বসল। জানলা বন্ধ। ঘরের মধ্যে ঘরের গন্ধ। ঘরের গন্ধ আত্মীয়। অনেক সময় বাইরে কাটিয়ে, ঘরে ফেরার কান্না মনে বাড়ি এলে বোঝা যায়। সে গন্ধে বাবা, মায়ের গন্ধ মিশে।
ছ-বছরের ছেলে পাশের ঘরে ছিল। টিভি দেখছিল। বাবা মায়ের মধ্যে গিয়ে বসল,
বলল, চলো বেড়াতে যাই।
এত রাতে? তার মা বলল। চোখদুটো তুলে কপালের দিকে।
বাবা বলল, বেশ, চলো সবাই যাই। রেডি হয়ে নাও।
বউ বলল, পাগল!
বউ উঠতে
উঠতে বলল। সাজতে সাজতে বলল। গুনগুন করে গাইতে গাইতে বলল, পাগল!
সবাই রেডি।
ছেলের গায়ে মোটা সোয়েটার ফুলহাতা। জিন্সের ফুলপ্যান্ট। গেলবার পুজোয় কেনা। মায়ের
গায়ে শাল। লালের উপর সাদা পাখি। বাবার গায়ে জ্যাকেট। মায়ের গায়ে নীল শাড়ি। চোখে
কাজল। ঠোঁটে লিপস্টিক। বাবার পায়ে বাদামী প্যান্ট। চোখে পরা নীচে আধখানা গোল চশমা।
যা দিয়ে বাবা তার দাঁত মাজার পর দাঁত পরিষ্কার হয়েছে কিনা দেখে।
টোটোটাকে
পিছনে নিয়ে রাস্তায় নামালো বাবা। মা ছেলে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে। জুতো শুঁকছে
পাড়ার লালু। লেজ নাড়াচ্ছে, যেন হাতপাখা। ছেলে বলল, বাবা লালুকে নিই? বাবা বলল, অন্যপাড়ার
কুকুরে বড্ড করবে ঝামেলা। তার চেয়ে থাক।
ছেলে তাকালো
কুকুরের চোখের দিকে। কুকুর তাকিয়ে তার দিকে। কাজল পরানো চোখ। ছেলেকে সে বলল, আমায় কেউ বেড়াতে নিয়ে যায় না দেখ, চ না নিয়ে!
ছেলে ধরল
জেদ। মা বলল, আচ্ছা। বাবা বলল, বেশ।
টোটো চলছে।
বাবার পাশেই, ওই ছোট্টো সিটে বসেছে মা। পিছনে সে আর
লালু। মা বাবার কানে আঙুল দিয়ে অ আ লিখছে। বাবার কাঁধে মাথা দিয়ে শুচ্ছে, যেন জ্বর। বাবাকে জড়িয়ে ধরছে কোমর বেড়ে। লালু দেখছে না। সে তার কোলের উপর
মাথা রেখে শুয়ে। ঝাঁকুনিতে মাঝে মাঝে ডাকছে, কেঁউ, কেঁউ। মানে সে বলছে আসলে, থ্যাংক ইউ… থ্যাংক ইউ।
ফাঁকা
রাস্তা। বাবা এত ধীরে গাড়ি চালায় না। তবু চালাচ্ছে। বাবা আর মা খুব মজা করে। সে
দেখেছে। সে ঘুমালে বাবা মায়ের উপর শুয়ে ট্রেন ট্রেন খেলে। তারা যখন পুরী যাচ্ছিল, যেমন ট্রেনের দুলুনি ছিল, বাবা তেমন দোলে। সে জেগে
গেলেও ডাকে না কাউকে। কে যেন বলে ডাকতে নেই। বাবা মাকে চুমু খায় তখন। অন্যরকম
চুমু। অন্যরকম আওয়াজ।
টোটো এসে
দাঁড়ালো ধানক্ষেতের মাঝে। বাবা নামল। মা নামল। লালু নামল। সে নামল। আর নামল এক
আকাশ তারা। সবাই বলল, এসেছিস!
চারজনে বসে
চুপ করে। রাস্তার উপর। গা ঘেঁষে ঘেঁষে। সে বসেছে মাঝখানে। লালু বসেছে পিছনে। বাবা
মা মাঝে মাঝেই চটকে দিচ্ছে তাকে। চুমু খাচ্ছে।
সে বলল, বাবা, তুমি কি হতে চেয়েছিলে গো ছোটোবেলা? টোটো ড্রাইভার?
বাবা তাকালো
আকাশে। তারারা বলল, মনে আছে?
ছেলে মাকে
জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি হতে চেয়েছিলে গো… বলো না আমায়!
মা তাকালো
মাটির দিকে। শিশিরভেজা ধানের শীষ বলল, মনে আছে?
বাবা তাকালো
মায়ের দিকে। মা তাকালো বাবার দিকে। দুজনে হাসল। মুখের মধ্যে যেন গোটানো মশারির মত
শান্তি, তবু ছড়ে যাওয়া হাঁটুর মত ব্যথা। তারপর বাবা তার গালে চুমু
খেয়ে বলল, কি হতে চেয়েছিলাম? তোর বাবা।
মা তার মাথায় চুমু খেয়ে বলল, তোর মা। কাল শ্যাম্পু করে দেব,
খুব জট।
তারা ফিরবে।
কিন্তু লালু কোথায়? এদিক ওদিক কত খুঁজল। কোত্থাও নেই। ছেলে
কাঁদল। বাবা বলল, কাল দিনের বেলায় আসব আবার, আনব খুঁজে। মা বলল, কাঁদিস না, ও ঠিক আসবে বাড়ি চিনে।
তারা বাড়ি
ফিরছে। মায়ের কোলে মাথা রেখে সে ঘুমাচ্ছে কেঁদে। গালের উপর কান্নার চটচটে শুকনো
নদী। মা ভাবছে কি হারালো যেন। বাবা ভাবছে কি হারালো যেন! তারারা হাত নেড়ে বলল, কিচ্ছু না। কিচ্ছু না। যা হারালো সে আবার আসবে বাড়ি চিনে। কিচ্ছু হারায়
না। আবার আসিস।