বালাপোষটায় দু-তিনবার হাত বোলালো মিতা। ন্যাপথলিনের গন্ধ বেরোচ্ছে হুহু করে। পুরোনো দিনগুলো যেন তরতাজা হয়ে আছে ন্যাপথলিনের আদরে। পাশের ঘর থেকে কাতরানোর আওয়াজ আসছে। থাকবে না লোকটা। বালাপোষটা?
এই বালাপোষটায় বড় মায়া। যখন নাতির জন্য সোনা বালাপোষটা চেয়েছিল, দেয়নি। কষ্ট হলেও বানিয়ে দিয়েছিল একটা। দিতেই হত। জামাই কিছু করলে তো কিনে দেবে? মাতাল শালা একটা।
মিতার উবু হয়ে বসে থেকে থেকে হাঁটুটা টনটন করছে। থাই দুটোও টাটাচ্ছে। কিন্তু উঠতে মন চাইছে না। উঠলে বালাপোষটা নিয়েই উঠতে হবে। এ জ্বর ছাড়বে না আর। এ কালজ্বর। বাবার দেখেছিল। এও যাবে। সিঁদুর মুছবে। আজকাল সিঁদুরের উপর আগের মত সে মায়া নেই? ভয়ও নেই বৈধব্যের। মনে মনে নিজেকে সিঁদুর ছাড়া, সাদা শাড়িতে অনেকবার দেখেছে। ভয় লাগেনি তো। লজ্জা লেগেছে এমন নির্লজ্জ স্বস্তির অনুভূতিতে।
কই গো…..
মানুষটা কোমর ভেঙে পড়ে আছে আজ প্রায় চার বছর। নইলে এখনও জনার্দন মিস্ত্রীর বাড়ি বললে এই বস্তিতে সবাই এক ডাকে চেনে। কিন্তু বালাপোষটা? এটা যদি দিয়ে দিই তবে আর তো ফিরবে না। ঘাটে দিয়ে দিতে হবে। মৃতের জিনিস ব্যবহার করা যায়?
মিতা ট্রাঙ্কটা বন্ধ করে দিল। বালাপোষটা আবার ন্যাপথলিনের দেশে হারিয়ে গেল। মিতা দাঁত-মুখ বিকৃত করে উঠে দাঁড়ালো। ব্যথায়। তবে ততটা শরীরের নয় যতটা মনের। আরো ভালো করে বললে বিবেকের।
ডাকছে না তো…..
নাতির আট বছর বয়েস এখন। হুড়মুড় করে ঢুকল। ঠাম্মি ঠাম্মি, দাদু কেমন আছে এখন? মরে গেছে?
মিতার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে এলো। মনে হচ্ছে….
কান্না পেলো না। ভয় করল। পাপ হল? চোখদুটো খোলা। পাখাটার দিকে তাকিয়ে। পাখাটা ঘুরেই যাচ্ছে। একটা মৃত মানুষকে হাওয়া দিচ্ছে। পাখাটা বন্ধ করে দিলেও তো হত! কেন মাথায় আসেনি? তবে তো বালাপোষ, বালাপোষ করত না লোকটা।
বস্তির লোকেরা আসতে শুরু করেছে। ভিড় বাড়ছে। গুনগুন শব্দ। গ্যাসে চায়ের জল চাপানো। চিনি দেওয়া। পাতাটা দেওয়ার আগেই….
বছর চার গেল। এখন মিতার ঘরে নতুন একজনের যাতায়াত বেড়েছে। অতীন ডাক্তারের। হোমিওপ্যাথি ওষুধ দেয়। সপ্তাহে দু'দিন বসে, মঙ্গলবার আর শনিবার। মিতার বাতের ব্যথা। ওষুধ যত পড়ে ব্যথা তত বাড়ে। রোগের সূত্রপাত জনার্দনের বেঁচে থাকার সময়েই ছিল। এখন লক্ষণগুলো ফুটে ফুটে বেরোচ্ছে।
শীতের বৃষ্টি হতচ্ছাড়া বৃষ্টি। অতীনের রুগী কম হয়েছে। কফি নিয়ে এসেছে অতীন আজ। দুটো ছোটো শ্যাম্পুর প্যাকেটের মত কফির প্যাকেট। কফি খেলে অম্বল হয় মিতার। কিন্তু অতীন বানাবে তো আজ। অম্বল সহ্য হয়ে যাবে।
অতীন সাদা জামা আর কালো প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে গ্যাসের সামনে। মিতা খাটে আধশোয়া। আজ ব্যথাটা অনেক বেশি। রোগা অতীনের রোগা হাত, রোগা আঙুল। কি সুখ আছে? শরীরের সুখ চকমকির সুখ। সুখী হতে গেলে বুকের মধ্যে ভালোবাসা জন্মাতে হয়। উথলে ওঠা ভালোবাসা না জন্মালে সুখ দাঁড়ায় না। বস্তিতে তাদের নিয়ে কথা হয়। হোক। মানুষ নিজেকে এত বোকা বানায় কেন? শরীরের সুখ কি সুখ? এই আছে, এই ফুরিয়ে গেল। অতীনকে সে কি শরীরের জন্য চায়? না অতীন তাকে শরীরের জন্য চায়? অতীন কথা বলে। মিতা কথা বলে। কথা বলতে বলতে ঘরটা ধুপের গন্ধে ভরে যায়। শরীর জাগলে সে উপলক্ষ্য হয়, উদ্দেশ্য হয় কই? মানুষ এত বোকা কেন? এত কেচ্ছা, এত নোংরা কথা কেন? সব তো শরীর নিয়ে। তিলকে তাল করা মানুষের স্বভাব।
মিতার কোলের উপর বালাপোষের ঘের। অতীন কফি নিয়ে সামনে বসে। দুটো কাপ। ধোঁয়া উড়ছে। অতীন ওর দেশের গল্প করতে ভালোবাসে। মানে বাংলাদেশের ওর গ্রামের গল্প। মায়ের গল্প। বাবার গল্প। ওর বাবা নাপিত ছিল। কিভাবে এ দেশে এলো। কত কষ্ট করে ডাক্তারি পড়ল। সে গল্প। অনেকবার শোনা। কিন্তু ফুরায় না। কথা তো শরীর। অনুভব মন। কথার শরীর বেয়ে হাঁটে।
অতীনের ফোন বাজল। অতীন ফোনটা প্যান্টের পকেট থেকে বার করতে গিয়ে কফির কাপ উলটে পড়ল বালাপোষে। সঙ্গে সঙ্গে জনার্দন হেসে উঠল পাশের ঘর থেকে।
অতীন বালাপোষের জন্য শুধু একবার, "এ বাবা", বলে দরজার কাছে গিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। রুগীর সঙ্গে কথা হচ্ছে। অহঙ্কারী মানুষ ভীষণ। গলার স্বরটায় অহঙ্কার মাখিয়ে কথা বলে রুগীদের সঙ্গে কথা বলে যখন। মানুষ কি শুধু টাকা উপার্জন করে? মানুষ সুখ, মান অনেক কিছু কামাতে চায়। অসুখী মানুষও মিথ্যা মানের ভেক ধরে সংসারে ঘোরে দেখেছে মিতা।
ওয়াড়টাই শুধু না, বালাপোষের গায়েও লেগেছে কফির দাগ। ওয়াড়টা জলে চুবিয়ে দিল। বালাপোষের গায়ে ভিজে গামছা দিয়ে ডলে ডলে মুছতে মুছতে শুনল অতীন বলছে, ও চলে যাচ্ছে, একটা ইমার্জেন্সি কল আছে।
মিতার একটা চোঁয়া ঢেকুর উঠল। অম্বল হয়ে গেছে। বালাপোষটা পাশের ঘরের মেঝেতে মেলে পাখা চালিয়ে খাটে এসে শুলো। মাথাটা ধরেছে। অম্বলের লক্ষণ। আজ রাতে খাবে না। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।
অনেক রাত। মিতা শুনল পাশের ঘর থেকে নাক ডাকার আওয়াজ। জনার্দন। মিতা উঠল না। ঘুমাক মানুষটা। বিবেককে মাড়িয়ে সুখী হওয়া যায় না। মিতা কি চায়? শরীর? না তো, সুখ। ধুপের মত সুখ। অতীনের কফির গন্ধে, জনার্দনের নাক ডাকার আওয়াজে ঘুম আসছে মিতার। আবার সেই প্রিয় স্বপ্নটা গুটিগুটি পায়ে মাথার মধ্যে বসছে।
একটা মেয়ে ঘুড়ি নিয়ে এক পা, এক পা করে ছাদের দিকে যাচ্ছে। অল্প অল্প আকাশ দেখা যাচ্ছে। এই তো আকাশ। ঘুড়ি উড়ছে। নীল আকাশে নীল ঘুড়ি। মিতা মিলিয়ে যাচ্ছে। ডুবে যাচ্ছে।