Skip to main content
( ঘরের মধ্যে যে দায়িত্ব বর্তায়, দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালে সে দায়িত্ব বদলে যায়। বাইরের দরজা খুলে রাস্তায় এসে পড়েছি অনেকদিন হল। এ লেখা সেই দায়বদ্ধতা থেকেই। অনুগ্রহ করে জানবেন কারোর আবেগে আঘাত করার উদ্দেশ্যে এ লেখা নয়, আমার অজান্তে হয়ে গেলে ক্ষমাপ্রার্থী, সত্যের উপর একটা দায়বদ্ধতা থেকে এ লেখার সূত্রপাত।)
 
 
ছেলেটা মেয়েজাতটাকে ভালোবাসতে পারতো না, তাই শ্রদ্ধা করত প্রাণের সমস্ত শক্তি দিয়ে। কারণ যাকেই না শ্রদ্ধা করি তা-ই বিরুদ্ধ শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েজাতের মত এত বড় একটা শক্তিকে বিরুদ্ধসত্তা বানিয়ে লড়তে চাইলে মনের শান্তি বিঘ্নিত হয়। তাই সুবর্ণ মেয়েদের শ্রদ্ধা করত। সে নিজেও কারণটা স্পষ্ট বুঝত না যদিও। কিন্তু সে খেয়াল করত মেয়েদের নারীরূপটা সে মেনে নিতে পারে না। সেটা যেন পাশ্চাত্য সভ্যতার একটা বিকাররূপ তার কাছে। মেয়ে মানে মা। মেয়ে মানে একটা আশ্রয়। এমনকি ভারতীয় মেয়েদের পর্ণও দেখলে অসহ্য লাগত সুবর্ণ'র। ওরকম হয় না ভারতীয় মেয়েরা।
        সুবর্ণ'র পরিবারের সবাই রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত। সুবর্ণ ছোটোবেলা থেকেই সেই পরিবেশে বড় হয়েছে। তার পরিবারের কয়েকজন মঠের সন্ন্যাসীও ছিলেন। সুবর্ণ মেয়েলী। লোকে বলতো হিজড়া। সুবর্ণ জানে সে আসলে হিজড়া নয়। সে মেয়েলী। তার কণ্ঠস্বর মেয়েদের মত। তার হাঁটা-চলা ইত্যাদিও মেয়েদের মত। তার মেয়েদের কাপড় পরতে ভালো লাগে। সুবর্ণ ‘কথামৃত’–এ পড়েছে ‘ভবনাথ মেয়েদের কাপড় পড়ে শোয়’। তার ভিতর ঠাকুর দৈবী শক্তি দেখেছিলেন। বলতেন, স্বামীজি হল মাদা আর ভবনাথ মাদী। সুবর্ণ নিজেকে দেবীর অংশ ভাবে। সুবর্ণের লিঙ্গের উত্থান হয় না। সে জানে সে জন্মসিদ্ধ তাই তার শরীরে কামবোধ নেই। কিন্তু একেবারেই কি নেই? তাও নয়। তার পুরুষের প্রতি একটা গভীর আকর্ষণ আছে। কিন্তু সুবর্ণ জানে সেটা কাম নয়, সেটা আধ্যাত্মিক সাধনার একটা স্তর। নিজের মধ্যে প্রকৃতিভাব দৃঢ় হলে সব পুরুষকে কৃষ্ণের অংশ বোধ হয়। আসলে সে কৃষ্ণকেই চাইছে।
        সুবর্ণ মাষ্টার ডিগ্রী করছে। পড়াশোনায় ভালো। দেখতে খুব সুন্দর। ক্লাসে বলে - ঐশ্বর্য্য রায়। ফরসা, ক্ষীণদেহ, টিকালো নাক, চোখগুলো কটাকটা। চলনে যেন সাপের গতি। লোকে বলে – হোমো। সুবর্ণ জানে সে হোমো নয়। সে প্রকৃতির অংশ। সে নারীরূপের সাধিকা। ঠাকুরের তো মাসিকও নাকি হত, যেমন 'রামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ'-এ লেখা আছে। সুবর্ণ'র খুব সাধ হয় তারও হোক। বাড়িতে কেউ না থাকলে সে তার মায়ের বেণারসীটা পরে। কাজলের টিপ পরে, চোখে কাজল দেয়। নথ পরে। ক্লিপের মত করে দুল লাগায়। মাঝে মাঝে বিভোর হয়ে যায় এত নারীসত্তায় যেন সে পুরুষ নয়ই। নিজের পুরুষাঙ্গটাকে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিতে মন চায় তার। নিজের সমতল বুকদুটোতে হাত বোলায়। কেন সে নারী নয় সম্পূর্ণ! মাঝে মাঝে কোনো পুরুষ তার মাথার মধ্যে ঢুকে তাকে পাগল করে দিয়ে তার শাড়ি সিক্ত করে বেরিয়ে যায়। সুবর্ণ কাঁদে। তার শুদ্ধ প্রেমে কামের ছোবল কেন? পরক্ষণেই ঠাকুরের কথা মনে পড়ে – কাজলের ঘরে থাকলে একটু কালি তো লাগবেই... তোমাদের শরীর কাম না হলে একবারে টিকবে না... সুবর্ণ ঠাকুরের সামনে কাঁদে। 
        সুবর্ণ যত পরিণত হতে থাকল, তার মনের মধ্যে জটিলতা তত ঘোরালো হতে শুরু করল। সে নাচ শেখে। নাচ তার খুব স্বাভাবিকভাবেই আসে। আঁকা শেখে, সেটাও খুব অনায়াসেই হয় তার অন্যদের থেকে। সে শুধু বুঝতে পারে না মেয়েদের। সে কি নারীবিদ্বেষী? তা তো নয়। কিন্তু কেন যেন সহ্যই করতে পারে না সে বেশিক্ষণ মেয়েদের। তার কি ঠাকুরের মত হল? অনেকক্ষণ মেয়েদের ঠাকুরও তো সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু তার মধ্যে ঈশ্বরের জন্য সেই জ্বলন্ত প্রেমের আগুন তো জন্মাচ্ছে না। মাঝে মাঝেই সে ঈশ্বরকে আর নারীকে --- দুইজনকেই ভুলে যায়। নারী না, মা । সুবর্ণ'র মেয়েদের অনাবৃত স্তন দেখলে গা গুলায়। যেন কি বিশ্রী। তার মেয়েদের যোনিপথ দেখলে বমি আসে, কি নোংরা! সুবর্ণ মেয়েদের চায় না তা তো নয়, সে চায়। কিন্তু মেয়ে না, মা রূপে চায়। ঠাকুরও বলেছেন, মেয়েদের নাকের, কানের ছিদ্র তিনি খুব বড় বড় দেখতেন, সুবর্ণও দেখে। সুবর্ণ'র মাঝে মাঝে ভয় করে, সে কি অবতার? আবার মাঝে মাঝে ভালোও লাগে, সে যেন অবতার।
 
 
        আমার সাথে সুবর্ণ'র আলাপ হল একটা গানের অনুষ্ঠানে। খুব ভালো গান গাইত। গানের শখ আমার বরাবর। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এমন গান গাও, তাকে সিরিয়াসলি নাও না কেন? সে হাসল। ক্রমে ‘তুমি’টা আমার ‘তুই’ হয়ে গেল, কিন্তু তার ‘আপনি’টা ‘তুমি’-র নীচে আর নামল না। কেন জানি না সুবর্ণ'র একটা গভীর আস্থা আমাতে জন্মালো। সে তার ব্যক্তিগত ডায়েরী আমায় দিল। তাতে এমন অনেক কিছু পড়লাম যা আমার সত্যিই অজানা ছিল, একজন পুরুষের এইসব অনুভব হয়? কিন্তু হত যে সে নিয়ে তো সংশয় নেই। সুবর্ণ আমার থেকে দেড় বছরের ছোটো ছিল। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওর গভীরতায় আমি মুগ্ধ হতাম, মনে হত কত এগিয়ে ওর বিচার শক্তি। ক্রমে অনুভব করেছিলাম, ওগুলো সুবর্ণ'র গুণ নয়, ওগুলো ওর ঢাল। ঢালের জন্য কেউ গর্ব অনুভব করে না। সুবর্ণও করত না। ঢাল মানুষের দুর্বলতার সাক্ষী। সুবর্ণেরও তাই।
        ক্রমে খেয়াল করলাম সুবর্ণ'র মধ্যে একটা অস্থিরতা বাড়ছে। সে যেন কিছুই সহ্য করতে পারছে না তার চারদিকে। এড়িয়ে চলছে বন্ধুবান্ধবদের। অবশ্য পড়াশোনায় খুব একটা প্রভাব পড়তে দিচ্ছে না সেটা তার রেজাল্টই প্রমাণ করে দিচ্ছে। তবু সুবর্ণ যেন কি একটা অস্থিরতায় ভুগছে। অস্থিরতাটা যেন একটা রোগের মত তাকে গ্রাস করছে ধীরে ধীরে। সুবর্ণ সিগারেট ধরল, মদ ধরল, গাঁজা ধরল। সবই আমার সামনেই ঘটে যেতে লাগল। কিন্তু আমি বারণ করতে পারলাম না। তার একটা কারণ আমি আমার নিজের কাজে তখন অত্যন্ত ব্যস্ত; দুই, মনে হত ও যদি এসব করেও ভালো থাকে তবে তাই থাকুক। ক্রমে সুবর্ণ'র চরিত্র নিয়ে কানাঘুষো শুরু হল। কোন মেয়েকে নাকি অশ্লীল কথা বলেছে। কোন সিনিয়ার দাদার রুমে নাকি অনেক রাতে যেতে দেখা গেছে। আমি শুনছি সব, কিন্তু সুবর্ণ নিজের চারদিকে এমন একটা বেড়া টেনে রেখে দিয়েছে যে সেটা পেরোতে গেলে একটা কোথাও যেন অভদ্রতা হয়। কেন অভদ্রতা হয় সেটা যদিও স্পষ্ট ছিল না আমার কাছে। তবে এখন মনে হয়, বোধহয় আমার ইগোতে লাগছিল। পাছে ও অপমান করে, কিম্বা উত্তর না দেয়। উত্তর না দেওয়াটা তো উপেক্ষা না... সে-ও বা সহ্য করি কি করে?
 
 
        অবশেষে সুবর্ণ খারাপ ছেলে হয়ে গেল লোকের কাছে। কিন্তু তার রেজাল্টের ঢাল, তার তীব্র তীক্ষ্ণ ধারালো ভাষার কাছে কেউ খুব একটা বড় কেতা দেখাতে পারত না। সেই জ্বলুনীটা তার সহপাঠিদের মধ্যে হয়ে উঠছিল আরো প্রবল। ফলত তাকে নিয়ে আলোচনার রঙও আরো চড়া হতে শুরু করল। যার কল্পনায় চরিত্রহীনতার যত দূর দৌড়, সে সব রূপ নিতে লাগল সুবর্ণ'র নাম ধরে। সুবর্ণ নির্লিপ্ত থাকত, যদি না তার সামনে এসে কেউ কিছু বলত বা ইঙ্গিত করত।
        সুবর্ণ'র সাথে অবশেষে দেখা হওয়ার বিরাম এলো। সুবর্ণ মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো। আজ জানিও না সে কোথায় আছে কি রকম আছে। আজ এত বছর পেরিয়ে এসে আবার যখন সুবর্ণ'র মত এক চরিত্রের সম্মুখীন হলাম, তখন মাথাটা এক রকম চক্কর খেয়ে, লিফটে যেমন ধাঁ করে দশতলায় চক্ষের নিমেষে দাঁড় করায়, সেইরকম এতগুলো বছর পেরিয়ে তার সামনে আবার এসে দাঁড়ালাম। ফেসবুক খুঁজলাম, কমোন বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করলাম। অনেকের তাকে আজ মনেও নেই। পেলাম না।
        কিছু প্রশ্ন শুধু ভিড় করে আসছে। সেদিন যদি সে নিজেকে স্বীকার করে নিত, সেদিন যদি সে মেনে নিত নিজেকে স্পষ্ট করে, এই সংশয়ে কি সে পড়ত? একটা মেয়েকে ভালোবাসার ক্ষমতা থেকে যদি সে নিজেকে বঞ্চিত না রাখত, একজন নারীকে সে যদি মানুষ হিসাবে, একজন নারী হিসাবেই ভালোবাসার অনুমতি তার অন্তরের সত্তা থেকে পেত, তবে কি এমন হয়ে যেত? তার মুখে বহুবার ‘কামিনী’ ত্যাগের কথা শুনেছি। মেয়েদের শ্রদ্ধা আর নিন্দা দুটোই খুব অতিরিক্ত লাগত আমার কাছে। তবু তাকে বেশ কিছুদিন প্রশ্রয় দিয়েছিলাম নিজের মনের জগতে নির্বিচারে, বেশিদিন পারিনি। কিছুটা সেই জন্যেই সে আমার সঙ্গও ত্যাগ করতে আরো বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছিল। দোষ আমারও ছিল। তাকে কোনো মনোবিদের কাছে হয়ত নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু সেদিন সাহসে হয়ত আমারও কুলায়নি, ও যদি ভাবত ওকে আমি পাগল প্রমাণ করতে চাইছি?
        আজ, বহুদিন বাদে কেন এ লেখা লিখতে বসলাম? কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত তো বটেই। তবে তার চাইতে বড় ইচ্ছা, এ লেখা যদি কোনো সুবর্ণকে নিজেকে নিজের মত করে শ্রদ্ধা করে বাঁচতে শেখায়; বাঁচতে শেখায় বিজ্ঞানের আলোকে; ধর্মের অতীন্দ্রিয় কুয়াশার মধ্যে অস্পষ্ট বোধের যুপকাষ্ঠে বলি না হয়ে।