সত্যের উপর ভালোবাসা নেই অথচ দেশের উপর, ধর্মের উপর, স্বজাতির উপর ভালোবাসা আছে যারা বলে, তারা আদতে মিথ্যাই বলে। সুচারু রূপে বলে।
যদি বলো, তাদের কাছে ওই দেশ, ধর্ম, স্বজাতিই হল সত্য। তবে সেটা কথার কথা। এ যেন কেউ বলছে, ওই আপেল পড়াটাই আমার কাছে মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব, আপেল না থাকলে আমার কাছে কোনো মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বই নেই।
এত এত রাশি রাশি মিথ্যা বলা, শোনা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, এখন আর অসুবিধা হয় না। মিথ্যা মানুষকে দুর্বল করে, ভীরু করে। এ জানি। প্রাণে প্রাণে অনুভবও করি, একা দাঁড়ানোর সাহস আমার নেই, কারণ আমার সত্যের প্রতি সে আনুগত্য নেই। কুকথা, নিন্দা, কুৎসায় চারদিক ছেয়ে যাচ্ছে। সবাই জানি সবটা মিথ্যা। কিন্তু নিজের মধ্যে সত্যের জোর নেই বলে বাইরে সেই জোরটা খুঁজে পাচ্ছি না। সত্যকেই ভাবছি অলীক কিছু একটা। ক্রমে দুর্বল হচ্ছি, ক্ষীণপ্রাণা হচ্ছি, কিন্তু নিজের ভালোবাসাকে সত্যানুরাগী করে তুলতে পারছি না।
কিন্তু যত দূর, যত গভীরে ভাবি না কেন, সত্যিই কি সত্যের আশ্রয় ছাড়া আমাদের কোনো আশ্রয় কোনোদিন সম্ভব? নয় তো। আমরা যদি নিজেদের চারদিকে এইভাবে সত্যকে অস্বীকার করে চলি তবে এইভাবেই বিকিয়ে যাব তাদের কাছে যাদের আমাদের চাইতে সত্যপ্রিয়তা অনেক বেশি। আমরা আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতির প্রতি যে আস্থা হারাচ্ছি রোজ অল্প অল্প করে তার কারণ এই নয় যে আমাদের ভাষা বা সংস্কৃতি অযোগ্য হয়েছে, কারণ তা নয়। কারণ আমাদের চরিত্রে সত্যপ্রিয়তা কমেছে। আমরা আস্ফালনে, স্বগর্বে চিরটাকাল সবার উপর দিয়ে হেঁটে যাব ঠিক করেছিলাম। তা হয় না। সত্য আমার ধার ধারে না বলেই তা সত্য। তাই সত্যের উপর নির্ভর করাতে আমার গৌরব, আমার নিশ্চিন্তি।
আমাদের মনীষীদের একটা বড় জোর ছিল সত্যের জোর। আমরা হারিয়েছি। আমাদের ভাষা যত চতুর হয়েছে, আমাদের ভাব যত বিচিত্রগামী হয়েছে, আমাদের চিত্ত তত সরলসত্য বিমুখ হয়েছে। ফলে আড়ম্বরে ত্রুটি ঘটেনি, ঘটেছে সত্যের অনুরাগে। সে মনীষীদের জীবনে কখনো কোনো বিচ্যুতি ঘটেনি তা নয়, ঘটেছে। আমরা ক্রমে সে বিচ্যুতির মধ্যে সমগ্র মনীষার ব্যর্থতা খুঁজে আত্মপ্রসাদ লাভ করার চেষ্টা করেছি, তবে আমার আর কি দোষ! এইতে আমাদের অধঃপতনের রাস্তা আরো সুগম হয়েছে। আমরা শ্রদ্ধা হারিয়েছি, কিন্তু কৌশলে গর্ব করার স্বভাবটা ছাড়িনি। এ যে চূড়ান্ত দ্বিচারিতা।
আমাদের সব কাজে এই দৈন্য চোখ মেলে তাকালেই ফুটে বেরোচ্ছে। ওই যে বললাম, আমাদের কাজ বিচিত্রগামী হয়েছে, নানা তত্ত্বকে সত্য জেনে তার প্রচারক হয়েছি, কিন্তু মূল কথাটা ভুলে বসে আছি যে সত্যের কোনো দল হয় না, দেশ হয় না, তত্ত্ব হয় না, মত হয় না। সত্যকে প্রচার করা যায় না। শুধুমাত্র সত্যানুরাগী হয়ে ওঠা যায়। শুধুমাত্র সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করার শুদ্ধ ক্ষমতাটা থাকতে হয়। সত্য মিথ্যার বিরোধী নয়, সত্য মিথ্যানাশী। আলো অন্ধকারের বিরোধী নয়, আলোটুকু জ্বাললে অন্ধকার আপনিই চলে যায়। আমাদেরও সেইটুকুই কাজ। শুধু সত্যটাকে আঁকড়ে ধরলেই, শুধু সত্যর প্রতি আনুগত্য ভালোবাসা জন্মালেই আবার সব ঠিক জায়াগায় আসবে। মনীষীদের মনীষাকে নিজের চিত্তে অনুভব করব। তাদের ছবি নিয়ে দল তৈরি করার দরকার হবে না। এই সামান্য, অতি সামান্য শিক্ষাটুকু যদি আজকের বাঙালি সন্তান না পাচ্ছে, তবে হাজার রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ, বিদ্যাসাগরেও বাঙালিকে রক্ষা করতে পারবে না। কারণ ওনাদের জীবনের মূল সুর এইটুকুই ছিল - সত্যানুরাগ। রক্ষা করে কেবল সত্য, আর কিছু না, আর কেউ না। বাকিটা শুধু ভ্রম। শুধু আত্মপ্রবঞ্চনা।