আবেগ সত্য। সত্য আসলে সত্য না। খেলা মানে আবেগ। ধর্ম মানে আবেগ। উৎসব মানে আবেগ। ভালোবাসার রোম্যান্টিসজম, আবেগ। শত্রুতার রোম্যান্টিসজম আবেগ।
তবে সত্য কী? আবেগের গতিপথ। আবেগের দৃষ্টি। আবেগের সঞ্চয়। আবেগের তিরস্কার। আবেগের ভর্ৎসনা।
বিচার বিবেচনা? আছে। ব্যাকফুটে। আবেগ যখন পরাহত। আবেগ যখন ঘুমন্ত। আবেগ যখন শ্রান্ত। তখন তার আবির্ভাব। প্রবল ঝড়ের পর যেমন মানুষ বিষণ্ণ, হতাশ মনে ঝড়ে ভাঙা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটের ক্ষতির হিসাব দেখে ফেরে, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বিচার বিবেচনা তেমনই বিষণ্ণ হয়। কিন্তু সে নিরুপায়। জানে আবার ঝড় আসবে। আবার নোঙর ছিঁড়বে। আটকাবে সাধ্য কী?
বিচার-বিবেচনা মানুষকে কী দেয়? হতাশা। বিষাদ। ক্লান্তি। মানুষ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বলে, "ধুর অত ভেবো না তো"! হ্যাঁ, ভাবনাকে সে এতই অপছন্দ করে। ভাবনা বিষণ্ণতামুখী। আবেগ তা নয়। যে ভাবুক, সে বিষণ্ণ, সে সব কিছুতে নঞর্থক। তাকে সরিয়ে রাখো। আপাতত আবেগে ভাসো। জীবন মানে তো আবেগ।
তবে তুমি সত্য কোথায় খুঁজে ফেরো? খবরের কাগজে? নিউজ চ্যানেলে? সম্পর্কে? সমাজে? থ্রিলারে? ধর্মে? সত্যের নামে তোমাকে স্ট্যাটেসটিকস ধরিয়ে দেবে। ডেটা ধরিয়ে দেবে। রাইট টু ইনফরমেশন ধরিয়ে দেবে। এবার তুমি কী করবে? ওই তথ্য, পরিসংখ্যান জলে গুলে খাবে? তথ্য বেচে কত প্রতিষ্ঠান বড়লোক হয়ে গেল। তুমি কী করবে? আরো বিভ্রান্ত হবে। কারণ সব তথ্যই ডুবন্ত পাহাড়ের জলের উপরে ভাসা দৃশ্যমান চূড়াটুকুর উপরে বসা একটা এককোষী জীবের সহস্র ভগ্নাংশের একটি ভগ্নাংশের চাইতেও ক্ষুদ্র। কী করবে?
জীবন আবার আবেগের দরজায় কড়া নাড়বে। আবার বলবে পেয়ালা ভরে দাও। আমি ক্লান্ত। আমাকে শেষ করে দাও। প্রবল সুখে। প্রবল দুঃখে। প্রবল উত্তেজনায়। খালি আমাকে ভাবতে দিও না। আমার বিচার-বিবেচনার পাঠ থাক বইয়ের পাতায় মৃত অক্ষরের নীচে চাপা। আমাকে মুক্তি দাও।
আবেগ না। বিচার বিবেচনা না। এসব থেকে এড়িয়ে সেই প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতার শিমুলগাছটার কাছে ছুটে যেতে পারো? যে একা দাঁড়িয়ে আছে। যাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। শব্দায়িত করা যায় না। আবেগে রঞ্জিত করা যায় না। ভাবনায় বিষণ্ণায়িত করা যায় না। যার কোনো মানচিত্র নেই। অথচ সে আছে। সে আছে বলেই আমার মধ্যে একটা প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতার মত শিমুলগাছ আছে। সে কে? হয় তো সে জীবানন্দের কবিতার বোধ। কিম্বা হয় তো সে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মত যেতে না চাইবার আত্মবিশ্বাস। কিছু তো সে। কে? জানি না, কিন্তু জানিও তো বটে।