Skip to main content

একটা বাড়ি থেকে প্যাকেটটা দিল। বলল, আজ অষ্টমী, খেও ঠাকুমা।

ভুলু প্যাকেটটা নিয়ে আরো চার বাড়ি ঘুরে বাগবাজার স্টেশানে যখন এলো পৌনে একটা। দেড়টায় ট্রেন, বারাসাত মাঝেরহাট। না, তার কোথাও যাওয়ার নেই, তার কোথায়ই বা যাওয়ার থাকবে! কে আছে কোথায় তার?

ভুলু হাত-পা ছড়িয়ে টানটান হয়ে বসল। আজ স্টেশানে বেশ লোক। পাশেই বাগবাজারের পুজো না? সাবিত্রীদিও তো ওখানেই ভিক্ষা করে। অত বড় বাড়ির মেয়ে সাবিত্রীদি, কিন্তু ওই যে কপাল… নইলে মাথা খারাপ হবে কেন? সাবিত্রীদি ইংরাজি পড়তে পারে… কি আশ্চর্য!

ভুলু ইংরেজি বাংলা কিচ্ছু পড়তে পারে না। সোনাখালিতে বাড়ি ছিল। বিয়ে হল, বর রাজমিস্ত্রী। মালখোর। অকালে নিজেও গেল। তাকেও ভাসালো।

নতুন শাড়ির গন্ধ আসছে… কত রকমের শাড়ি, ভুলু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। তার পাশ থেকেই তো যাচ্ছে সব, তার ছোঁয়া বাঁচিয়ে। নেপালের ছেলেমেয়ে দুটো লাইনের পাশে আবর্জনা থেকে খুঁজছে বোতল-টোতল। আট কি নয় হবে ওদের বয়েস। ভুলু নিজের ছোটোবেলাটা ভাবল। এদের চাইতে ভালো ছিল অনেক। মা ক'বাড়ি বাসন মাজত। বাবা ছোটোবেলায় মরেছিল, সাপের কামড়ে।

আকাশ জুড়ে মেঘ। সাবিত্রীদি বলছিল এবার পুজোয় বৃষ্টি হবে। হলও তাই। সাবিত্রীদি সব জানে, শুধু সুখী হতে জানে না।

প্যাকেটে চারটে লুচি, আলুরদম আর একটা মৌচাক আছে। জিভে জল এলো। কানের পাশ থেকে চোয়ালদুটোয় টাটিয়ে ব্যথা হল। এরম হয়, খুব খিদে-তেষ্টা পেলে।

ভুলু মাঝে মাঝে মায়ের বাড়ি যায়। মানে সারদা মায়ের বাড়ি। সেখানে একজন লোক আছে, সবাই তনুদা বলে, তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসে মানে ঘেন্না করে না। ভালোবাসার আর কোনো মানে ভুলু জানে না। আজ দুপুরে গেলে খেতে দিত। ইচ্ছা করেই যায়নি। লজ্জা লাগে।

ভুলু খাওয়ার পর টানটান হয়ে শুলো। আজকাল কাপড়চোপড় ঠিক রাখা বড্ড ঝামেলা। ব্লাউজটা এত ঢোলা হয়েছে যে মাঝে মাঝেই বাঁ কাঁধ থেকে নেমে যায়। খেয়াল থাকে না। কেউ তাকিয়ে থাকলে হুঁশ হয়। অবশ্য দেখারই বা কি আছে। তাই লজ্জা লাগে না, আদেখলা মনে হয়। এও দেখার?

লাইনের দিকে পিছন ফিরে শুলো। ট্রেনের কথা বলেছে দুবার। নেপালের ছেলেমেয়েগুলোর গলা আসছে। আরো অনেকের কথা আসছে। সব কথা মিলে মাথার মধ্যে ঢুকে কোনো কথা হচ্ছে না। সব মিশে একটাই ইশারা যেন, তোমার দরকার নেই… তবু তুমি কেন?

তনুদা বলে, এসব ভাবতে নেই। তনুদার মেয়ে, বউ সব মরে গেছে। করোনায়। তনুদা একা। বলে ভাগ্যের উপর কারোর হাত নেই দিদি..তুমি আমি সব পুতুল।

পুতুল কথাটা ভালো লাগে ভুলুর। ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে। পুতুল ছিল চারটে। নিজের ইচ্ছা মত বিয়ে দিত। আবার বিয়ে দিত। কত সাজাতো, স্নান করাতো। ভাগ্য নাকি পুতুল খেলে। সাবিত্রীদি বলে, পুতুল না, ফুটবল খেলে। ভগবান পায়ে পায়ে লাথি মেরে মেরে খেলে।

দুর্গার কথাই ভাবো। ফি বছর ছেলেমেয়ে তো আছেই, অসুরটাকেও নিয়ে আসবে। দুর্গার যখন বয়েস হবে? সামলাতে পারবে অসুরকে? অসুরদের তো বয়েস হয় না। আর নিজেকে পারবে সামলাতে? সে দুটো হাতেই ব্লাউজ সামলাতে পারবে না…. দুর্গার কি হবে?

ভুলু স্বপ্ন দেখছে পুতুলরা পায়ে পায়ে ফুটবল খেলছে। আর দুর্গা রতনের দর্জির দোকানে ব্লাউজের মাপ দিতে এসেছে।

দিদি… ও দিদি…

তনুদা। হাতে একটা শাড়ি আর খাবারের প্যাকেট।

এলে না কেন?

স্বপ্নটা মিলিয়ে গেল। ক'টা বাজে দাদা?

সাড়ে তিনটে।

এখন ট্রেন নেই আর। সেই সন্ধ্যেতে। তনুদা বলল, শাড়িটা পরো। যাও আমি বসে আছি।

গঙ্গার পাড়ে শাড়ি বদলানোর জায়গা আছে। সেখানে যে কেউ যায়।

ভুলু শাড়িটা হাতে নিয়ে বলল, আসছি।

নেপালের মেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ঠাকুমা তোমার নাম ভুলু কেন? ও তো কুকুরের নাম হয়….

ভুলু বলে, আমার বাবা জানতো তো আমি বড় হয়ে কুকুর হব… তাই রেখেই সাপে কেটে মরে গেল। মায়ের কাছে শুনেছে তার নাম নাকি তার বাবা রেখেছিল। খুব ইচ্ছা ছিল ছেলে হবে!

তনু বলল, বাহ! দারুণ লাগছে। এটা রাতে খেও বুঝলে, আর দশমীতে অবশ্যই এসো। মায়ের ওখানে আসতে হয়। মাকে প্রণাম করতে হয়, মা জ্যান্ত দুর্গা জানো তো?

ভুলু জানে, সত্যিই জ্যান্ত দুর্গা। সারদা মায়ের ছবির দিকে তাকালে মনে হয় কেউ একজন দেখছে তাকে। তার যখন জ্বর হল, এই স্টেশানেই চার পাঁচদিন বেহুঁশ পড়েছিল, কে দেখেছিল তখন? সারদা মা'ই তো। স্বপ্ন দেখত ভুলু, মা রোজ গঙ্গাস্নান করে উঠে তার কপালে হাত দিয়ে বলছে, ভালো হয়ে যাবি ভুলু, ভাবিস না। তখন করোনা চারদিকে। ট্রেনবাস কিচ্ছু চলে না। দোকানপাট সব বন্ধ। খাওয়া জুটত না প্রায় দিনই। ভুলু ভেবেছিল আর বাঁচবে না। কিন্তু বাঁচলো তো!

তনুদা চলে গেল। সন্ধ্যে হল। ভুলু মায়ের স্নানের ঘাটে এলো। এই ঘাটে মা স্নান করতে আসত। তনুদা বলেছে। ভুলু মায়ের মূর্তিতে প্রণাম করল। বলল, মা, সাবিত্রীদিকে ভালো রেখো মা। ও বড্ড বোকা। আজ সারাদিন কিছু খায়নি। খাবেও না, বলে নাকি অষ্টমীর দিন তাদের উপোস। আচ্ছা মা, ভিখারির আবার কি উপোস বলো? তুমি একটু বুঝিয়ে দিও।

ভুলু স্পষ্ট দেখল, মা হাসল।

ভুলুর প্রাণটা আনন্দে ভরে গেল। বাগবাজার দুর্গাপুজোর মণ্ডপের দিকে এগোতে গেল। পুলিশ আটকায়, এ আটকায়, সে আটকায়….. যা হোক অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে প্যাণ্ডেলের পিছনে একটা জায়গায় সাবিত্রীদিকে পেয়ে গেল।

সাবিত্রী বলল, কিরে ভুলু? এলি কি করে? মারল না?

ভুলু বলল, আরে মা পাঠালে কেউ আটকায়? সারাদিন খাওনি তো কিছু? চলো খেয়ে নেবে আমার সঙ্গে। এটা তনুদা দিয়ে গেল….

শাড়িটাও… না রে?

ভুলু লজ্জা পেল। সত্যিই শাড়িটার কথা মনে ছিল না তো। ছেড়ে এলেই হত। বোকামি হয়েছে। সাবিত্রীদির শাড়িটার দিকে তাকালে আরো লজ্জা লাগছে।

সাবিত্রীদি বলল, এরকম একটা শাড়ি আমার মায়ের ছিল, আমায় একদিন পরতে দিবি? তবে আমি খাব… আছিস্টি-কুছিস্টি যা দিবি খেয়ে নেব….

ভুলুর চোখে জল এলো। বলল, এ শাড়ি তুমিই নাও দিদি… বোন বলে কোনোদিন তো কিছুই হাতে করে দিইনি বলো…

গল্পটা এ বছরের হলে এখানেই ইতি পড়ত। কিন্তু তা তো নয়। যা হোক, সাবিত্রীকে আর বাগবাজারে কেউ দেখেনি। শাড়িটা পরেই সবাই তাকে শেষ দেখেছে। কেউ কেউ বলে সাবিত্রী নাকি তাদের বলেছে সে তার মাকে খুঁজতে গেছে কাশী, এই শাড়ির রংটা দেখলেই মা তাকে চিনতে পারবে, সে-ও পারবে।

ভুলু সবটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, তাই যেন হয়। তনুদা শুনে বলেছিল, বোকা কোথাকার!

কিন্তু সত্যিই যেন বোকা তাকে বলতে চায়নি তনুদা। সে জানে, এতটা বোকা তো সে নয়! মা চাইলে অনেক কিছু হয়। কিন্তু মা চাইতে পারে না। এটাই নিয়ম। কিন্তু কেন নিয়ম জানে না ভুলু। সবাই তবে দুর্গাকে হয় তো বোকা বোলতো। সত্যিকারের বোকা।