Skip to main content

সতেজবাবু নির্জীব থাকতেন, তিনি জীবনে কিছু করতে পারেননি বলে না, অনেকে অনেক কিছু করছে, অথচ তা তিনি করতে পারছেন না বলে মুহ্যমান থাকতেন।

এমনকি যেদিন চপ খেয়ে অম্বল হল, বুকে ব্যথা হল, ইসিজি রিপোর্টে কোনো গোলমাল না থাকা সত্ত্বেও যখন ভোরবেলা ইহলোক ত্যাগ করলেন, তখনও মুখের মধ্যে এক ঘোরতর বিমর্ষতা। লোকে বলল, উনি মরেও সুখ পেলেন না।

কথাটা ঠিক। সতেজবাবু কিছুতেই সুখ পেলেন না। তিনি যা পেয়েছেন তার চাইতে অনেকে অনেক বেশি পেয়েছে, এ কিছুতেই সহ্য হত না তার। এমনকি অযোগ্য লোকেও পেয়েছে।

মারা যাওয়ার পর ভেবেছিলেন শরীর গেল মানে সবই গেল। কিন্তু সমস্যা তো চিরকালই অশরীরী। মানুষের শরীরটুকু বাদ দিলে সুখ দুঃখ সবই তো আসলে অশরীরী। মন নিজেও তো অশরীরী, বুদ্ধিও তাই।

তাই সতেজবাবু দেখলেন যেটা সব চাইতে কম জ্বালালো সারাজীবন, সেটাই পুড়িয়ে দিল ওরা, আর যে মন আজীবন জ্বালিয়ে গেল, সে-ই আবার সঙ্গে এলো। হায় অশরীরী মানুষ! ভাবিস মরলেই মানুষ অশরীরী হয়, প্রতিটা মুহূর্তেই তো তুই অশরীরী।

সতেজবাবু কাঁদেন। ভাবেন। আবার কাঁদেন। মনও কাঁদে। ভাবে। সতেজবাবু ঠিক করলেন তিনি বাল্মীকির মত উলটো রামনাম জপ করবেন। যদি কিছু হয়।

হল। মন "মরা মরা" জপতে জপতে গুচ্ছের মরা মানুষের সঙ্গে ভাব জমালো। তাদের সবার মনের এক ব্যামো। তারা যা করেছে, পেয়েছে, তাতে সুখী নয়। সবাই একসঙ্গে বসে কাঁদে। ভাবে।

======

গল্পটা হয় তো এখানেই শেষ হতে পারত। হল না। একদিন কি মনে হতে সতেজবাবু মনটাকে উলটে দেখবার ইচ্ছা করলেন। ব্যস, যেমন ইচ্ছা তেমন গোলমাল। তিনি যত মনকে উলটে দেখতে চান মন তত সোজা কাঠের মত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সতেজবাবু দীর্ঘদিন বিমর্ষ থেকে থেকে জেদি হয়েছেন বেশ। একদিন মন যখনই একটু আনমনা হয়েছে, দিয়েছেন উলটে। ও বাব্বা, এ যে পুরো হাঁ! মাড়ির দাঁতের মধ্যে এমন একটা হাঁ হয়েছিল বেঁচে থাকতে। ডাক্তারের প্রায় দুই মণ পুডিং লেগেছিল সে দাঁত ভরাট করতে। সেই হাঁ-এ পোকা হয়ে, খাবার পচে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড। এও তো দেখি তাই। এই এত বড় ফাঁক হল কি করে? আর এই ফাঁকের উপর দাঁড়িয়ে তার এত হম্বিতম্বিই বা হয় কি করে?

সতেজবাবু এই প্রথম বিষণ্ণতা ছেড়ে ভাবনায় পড়লেন। তার ধারণা ছিল মনের শিকড় অনন্তকাল অবধি গভীরে। তার সব ক্ষোভ, জ্বালা, বাসনা একদম খাঁটি, ন্যায্য। কিন্তু সে এতবড় ফাঁকের উপর এত দম্ভ দেখায়! হায় রে হায়!

মন ভরাট করে কি দিয়ে?

এই প্রশ্ন একে তাকে করতে করতে একদিন ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে গেল। ছোটোবেলায় মন ছিল গোল। গড়াতে পারত তাই। কারণ রোজ খেলতে খেলতে চারদিক বেশ মসৃণ হয়েছিল। কিন্তু কবে যে খেলা বন্ধ করলেন… মন ধীরে ধীরে আয়তাকার থেকে বর্গাকার হয়ে গেল। নড়তে চড়তে চাইল না। নিজের উপর নিজে বসে বসে রাতদিন হিসাবনিকাশ করত আর দীর্ঘশ্বাস ফেলত।

আর ছাড়া নয়। মনকে বললেন, আমরা কিতকিত খেলব।

মন বলল, পায়ে ব্যথা।

সতেজবাবু বললেন, সাঁতার কাটব।

মন বলল, দম আসে না আর, আগের মত।

সতেজবাবু বললেন, ঘুড়ি ওড়াব।

মন বলল, আকাশের দিকে তাকালে ঘাড় টনটনায়। অন্য কাউকে দেখো।

এর মানে সতেজবাবু জানেন। অন্য কাউকে দেখো মানে আপাতত কাজ চালানোর জন্য প্রক্সি খোঁজো। বেঁচে থাকতে কতবার প্রক্সি মন নিয়ে বিয়েবাড়ি, জন্মদিনের পার্টি এইসবে গেছেন। সুখী মুখ করে। আসলে সেটা প্রক্সি মন, কয়েক মুহূর্ত বাঁচে। কিন্তু আবার সেই খেলা! প্রশ্নই নেই।

সতেজবাবু বললেন, হয় তুই খেলবি, নইলে ফাঁকা দিকটা উপরে করে বসবি, যাতে সবাই দেখতে পারে তুই কতটা ফাঁপা, আর কি জ্বালাই না আমায় জ্বালিয়েছিস!

মন বলল, সে না হয় আমি ফাঁপা দিকটা উপর করে বসছি, আমার কি… তোমারই কি মান থাকবে?

সতেজবাবু বললেন, থাকবে কিনা দেখা যাবে। খেলবি আয়।

মন বলল, পারি না।

সতেজবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তবে চ, ফাঁপা দিকটা নিয়েই বসি। শিশিরে, মেঘে, আলোতে, বৃষ্টিতে একদিন তো ভরাট হবেই। চ, আয়।