সতর্ক আর সচেতন - দুটো এক শব্দ কি? নয়। আমার দাঁতে ব্যথা, আমি সতর্ক হয়ে আছি, এই বুঝি ব্যথা লাগল। ঠাণ্ডা, গরম, কঠিন খাবার এড়িয়ে যাচ্ছি। ব্রাশ করছি সতর্কভাবে। আবার কারোর দাঁতে কোনো সমস্যা নেই, তবু সে দাঁতের যত্ন নিয়ে ভীষণ সচেতন। দুবেলা ব্রাশ করা, খুব ঠাণ্ডা-গরম এড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদির মাধ্যমে।
এক গ্রামে এক রহস্যময় লোক এলো। সে বলল, আমি দীর্ঘদিন হিমালয়ে তপস্যা করেছি, আমি অনেক কিছু আগে থেকে জানতে পারি। যেমন তোমাদের এই গ্রামে একটা বড় দুর্যোগ আসছে। তোমরা নিজেদের ডান হাতের কড়ে আঙুল নিয়ে সচেতন থেকো।
ব্যস, সেদিন থেকে সবাই তাদের ডান হাতের কড়ে আঙুল নিয়ে সচেতন হতে শুরু করল। সবাই সারাদিন কাজের মাঝে মাঝেই আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো পরিবর্তন হলেই সেই সাধককে জানাতে বলেছে। যদি কোনো পরিবর্তন চোখ এড়িয়ে যায়, তবে নাকি ঘটে যাবে অনর্থ।
ক’দিনের মধ্যেই দেখা গেল সত্যি সত্যিই সবার কড়ে আঙুলে কোনো না কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। কারোর মনে হচ্ছে আঙুলের ডগাটা ক্রমে চৌকো হয়ে যাচ্ছে, কারোর মনে হচ্ছে বেশি গোল হয়ে যাচ্ছে, কারোর মনে হচ্ছে নখটা ক্রমশ ধুসর হয়ে যাচ্ছে, কারোর মনে হচ্ছে নখের মাথাটা কাঁটা কাঁটা হয়ে যাচ্ছে, কারোর মনে হচ্ছে আঙুলটা সরু, কারোর মনে হচ্ছে আঙুলটা লম্বা, কারোর মনে হচ্ছে আঙুলটা বেশি আড়ষ্ট…. কত কত সমস্যা। গ্রামের মানুষদের ঘুম ছুটেছে। রাত জেগে জেগে উঠে উঠে সব আঙুল দেখে। আতশ কাঁচের তলায় রেখে দেখে। সত্যিই তো পরিবর্তন হচ্ছে! তবে তো আসন্ন বিপদ!
এই হয়। এক একজন আসে আর আমাদের এক এক বিষয়ে অতি সচেতন করে তোলে। আমরা সুক্ষ্ম বিচারে লেগে পড়ি। কারোর মনে হয় ধর্ম গেল, কারোর মনে হয় সংস্কৃতি গেল, কারোর মনে হয় ভাষা গেল, স্বাস্থ্য গেল। আরো কত কত কি যে মনে হয়, গেল গেল। আসলে কিছুই যায় না। অনেকদিন যখন পেরিয়ে যায়, যখন বোঝা যায় আসলে কই কিছুই তো গেল না, মাঝখান থেকে আমরাই নিজেদের কি ব্যতিব্যস্ত করে রাখলাম। কত চীৎকার, চ্যাঁচামেচি করলাম, কত খামচাখামচি করলাম, কত গালিগালাজ করলাম। কিন্তু আদতে ছায়া বানিয়ে ছায়ার সঙ্গেই তো লড়লাম।
কোনো বিষয়ে সচেতন আর সতর্ক থাকার আলাদা করে দরকার হয় না, যদি স্বাভাবিক থাকি। স্বাভাবিক জীবনের মধ্যে বেঁচে থাকার সব কিছুর অনুপাত ঠিক মাত্রায় থাকে। কিন্তু যে-ই না সেই স্বাভাবিক জীবনের অনুশীলন ছেড়ে আলাদা কিছু হতে চাই, করতে চাই, তখনই এর ওর ফাঁদে পা দিয়ে ফেলি।
দুঃখ শুধু তো কেবল কোনো কিছুর অভাবই নয়, দুঃখ বা ভোগান্তি কোনো কিছুর অতিরিক্ততাতেও বটে। অতিরিক্ত যা কিছু আমাদের অস্থির করে তোলে, অস্বাভাবিক করে তোলে। তাই ভোগান্তির কারণ খুঁজতে গেলে দেখে নেওয়া ভালো, সেটা কোনো কিছুর অভাবে, না প্রাচুর্যে?
আমাদের সমাজে, রাজনীতিতে, সংস্কৃতিতে, স্বাস্থ্যে মাঝে মাঝেই এরকম কোনো একটা দিক অতিরিক্ত কিছুর প্রবণতা মাথা চাঁড়া দিয়ে ওঠে। কেউ কেউ কোনো বিশেষ কিছু নিয়ে আমাদের অতিরিক্ত সচেতন করে তুলতে চান, মানে আমাদের ব্যস্ত রাখাতে চান। আমাদের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দকে বিভ্রান্ত করলে হয় তো কারোর কোনো লাভ হতে পারে, কিন্তু আমাদের তাতে করে কোনো লাভ নেই।
মানুষের জীবনের মূল সুরটাই হল যুক্তিপূর্ণ প্রয়াসে ব্যক্তি জীবনে আর সমাজ জীবনে সংহতি স্থাপন। এর বাইরে অতিরিক্ত করে যা চাইব, তা-ই আমাদের পক্ষে অমঙ্গলকর হবে। তার থেকে বেঁচে থাকাটাই সব চাইতে বড় শান্তি জীবনে।