Skip to main content

"মা বাড়ি আছেন?"
সাদার উপর নীল ফুল ফুল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছেন শাড়ি কাকিমা। মাঝারি উচ্চতা। প্রায় সব চুলই সাদা। চোখে কার্বন ফ্রেমের চশমা, দুটো হাতে দুটো বড় বড় চটের ব্যাগ। 
- না কাকিমা, মা বাড়ি নেই, আসবেন এক্ষুণি, আপনি আসুন। 
রেল কোয়াটার্সের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে কাকিমা উপরে উঠতে লাগলেন, একটা ব্যাগ কিছুটা জোর করেই হাত থেকে নিলাম। এরকমই গরমকালের কথা বলছি। বৈশাখ মাসেরই কোনো একটা দিন।
বড় বড় দুটো হলঘর, সামনে একটা মাঝারি বারান্দা, তার সামনেটা খোলা। বসে থাকলে আকাশ দেখা যায়, নীচে ঝুঁকলে সামনের রেলকলোনীর শুনশান বড় রাস্তা। 
পাখা চালিয়ে দিলাম। 
- তোমার কলেজ নেই আজ?
- না, কাকিমা।
- ও, বলে আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, "শিখা বৌদির বাড়ি হয়েই আসছি। উনি বেরোলেন হঠাৎ, আমি পড়লাম বিপদে, এই দুপুরে কোথায় যাই বলো, তাই ভাবলাম ভটচায্ বৌদির এখানেই আসি। তোমার মায়ের সাথে কথা বললে প্রাণটা জুড়ায়।" একটু হাসলেন অপ্রস্তুত। 
আমি বললাম, "তাতে কি হয়েছে, মা একজন কাকিমার বাড়িই গেছেন, চলে আসবেন খানিক পরেই, উনি হাসপাতাল থেকে গল ব্লাডার অপারেশান করে কালই ফিরেছেন, তাই দেখা করতে গেছেন।"
- কে বলো তো?
- মৌসুমী কাকিমা। আপনি চিনবেন হয়ত, নিউ কলোনিতে থাকেন। 
- চিনি না গো, একটু জল দাও তো। 
- ও হ্যাঁ, ভুলেই তো গেছি, আপনি বসুন এখনি আনছি, বলেই দৌড়োলাম।


---

- আপনি শাড়ির ব্যবসা শুরু করলেন কবে থেকে কাকিমা? অনেক আগে?
- না গো, শখে কি আর রাস্তায় নামলাম ভাই।
বাইরের দিকে তাকালেন, আকাশের দিকে। গ্রীষ্মের দাবদাহে একটা চিল উড়ছে। বাইরে রিকশার আওয়াজ কচ্চিৎ। 
- তোমার কাকু একটা সামান্য কাজ করতেন জানো তো? মিলে। ক'টা টাকাই বা মাইনে? আমার ছেলে পল্টু, উচ্চ-মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট তো করলই, উপরন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্টেও দারুন র‍্যাঙ্ক করল। তোমার কাকু বললেন, আমি পারব না। সত্যিই তো, অত টাকা পাবোই বা কোত্থেকে? তখন আমার এক দূর সম্পর্কের ননদ ছিল, সে বলল, বৌদি তুমি শাড়ির লাইনে এসো। বড় বাজার থেকে শাড়ি কেনো, আমি দোকান চিনিয়ে দেব, আর এখানে এসে বিক্রি করো। একবার লাইনটা বুঝে গেলে আর তোমায় ভাবতে হবে না। ব্যস সেই শুরু। 
কিছু বললাম না, কারণ উনি আমার সামনে বসেও আমার সামনে নেই। বাইরে তাকিয়ে, জলের গ্লাসটা ফাঁকা, তাও হাতে ধরে আছেন, পাখার হাওয়ায় কপালের সাদা কয়েকটা চুল উড়ছে। মুখটা ফর্সা, রোদে তেঁতে পুড়ে লাল। 
আমি চিন্তার ছেদ টানলাম, বললাম, "কাকিমা আপনার নাম তো শাড়ি কাকিমাই শুনে আসছি, আপনার আসল নামটা কি? হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করলাম।"
- টকি
- অ্যাঁ! টকি! হেসে ফেললাম, এরকম নাম কেন? 
- আরে আমাদের ছোটোবেলায় তো টিভি ছিল না, সে রেডিওর যুগ। আর ছোটোবেলায় নাকি খুব বকবক করতাম, তাই আমার ঠাকুর্দা আমার নাম রাখলেন টকি। ব্যস ওই হয়ে গেল আমার ভালো নাম, ডাক নাম সব..., বলে নিজেই হেসে ফেললেন। দাঁতগুলো পানের রঙে আর সাদায় মিশে একটা দিদা দিদা হাসি তৈরি করেছে। যদিও কাকিমা, টকি কাকিমা। 
বললাম, "ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ল।"
- হ্যাঁ গো! উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মুখ। বললেন, "শিবপুরে। এদিকে আমার শাড়ির ব্যবসাও জমে গেল জানো। প্রথম প্রথম খুব লজ্জা লাগত। কোনো কিছু দরকার লাগলে তোমার কাকুকেও মুখ ফুটে কিছু বলতে লজ্জা পেতাম, সেখানে অচেনা মানুষদের কাছে গিয়ে 'শাড়ি নিন' বলব কি করে? কি লজ্জা। কিন্তু ওই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই রাস্তায় নামলাম। ভগবান তো সব দিকে একেবারে মারেন না, তোমার মায়ের মত কিছু মানুষ জুগিয়েই দিলেন।"


---
মেঘ করছে। মনে হচ্ছে ঝড় আসবে। চারটে বাজে। 
কাকিমাই কথা শুরু করলেন, "এদিকে মেয়েটাও দারুন রেজাল্ট করল জানো, বাবুর থেকে বছর তিনেক ছোটো ছিল। ও বলল, ও বেথুনে পড়বে। আসা যাওয়া করা যাবে না, ওখানেই থাকতে হবে, মানে কলকাতায় মেস নিয়ে। খরচা বাড়লো। আমিও পরিশ্রম বাড়ালাম। আগে একবেলা বেরোতাম, তখন থেকেই দু'বেলা বেরোতে শুরু করলাম। হোটেলে খেতে শুরু করলাম। টাকা বাঁচাবার জন্য খেতামও না অনেক সময়, ওই করেই তো গ্যাস্ট্রিকে ধরল, তোমার মা জানে, জহরলালে ভর্তি ছিলাম বেশ কয়েক দিন।"
- ছেলে এখন কি করে?
- ছেলে তো বিরাট চাকরি করে। 
ও তাও, কাজটা ভালোবেসে ফেলেছেন আসলে।
- তোমার মা তো এখনও এলো না গো, এদিকে তো মনে হচ্ছে ঝড় আসবে। কি করি বলো তো? 
আমিও ভাবছি, তখন মোবাইল ফোন ছিল না এখনকার মত, যদিও ল্যাণ্ডলাইন ছিল, কিন্তু আমি তো ওই কাকিমার নাম্বার জানি না। 
- ছেলে আলাদা থাকে, কলকাতায় ফ্ল্যাটে। কিনেছে। 
গলার আওয়াজটা অন্যরকম শোনালো। মুখের উপর সেই ভাবটাও নেই। 
- বৌমা পছন্দ করে না আসলে, আর করবেই বা কি করে বলো, সে ইংরাজী মিডিয়ামে পড়া মেয়ে, খুব বড়লোক বাবা মা, ছেলে পছন্দ করে বিয়ে করল, কলেজেই পরিচয়। আর আমি আর তোমার কাকুর ইংরাজী জ্ঞান ওই 'এ ফর অ্যাপল' অবধি, মিশ খায়? তাই আমিই বললাম, তুই আলাদাই থাক বাবা, অশান্তি বাড়িয়ে কি লাভ বলো? এখনও সংসারে তো ঢোকোনি বাবা, খুব জটিল জায়গা, তুমি যা ভাববে তাই হবে, এ কেউ গ্যারেন্টি দিতে পারে না। এই যে তুমি যাকে বিয়ে করে আনবে সে যদি তোমার মায়ের সাথে না থাকতে চায়, তোমার মা কি তোমায় অসুখী দেখবে বলো?
ক্ষীণকন্ঠে বললাম, "মেয়ে?"
- সে-ও তো খুব বড় চাকরী করে বাবা, সে তার বরের সাথে ভিলাইতে থাকে। 
ঝড় উঠল। আমি দৌড়ে উঠলাম, জানলাগুলো আটকাতে হবে, দড়াম দড়াম করে পড়ছে। কাকিমার মুখের দিকে তাকালাম, খেয়াল করেননি। কত ঝড় পেরোলে মানুষের মুখ এমন নির্বিকার শান্ত হয় জানি না তো !


---
"তোমার কাকুর সেরিব্রাল অ্যাটাক হল তিন বছর আগে। শরীরটাও পড়ে গেল আর মাথাটাও গেল।"
বাইরে তুমুল ঝড় হচ্ছে, হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। 
- মা ফোন করেছিলেন, বললেন, আপনি যেন বেরিয়ে না যান। আর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি দুপুরে কিছু খেয়েছেন? 
আসলে আমারই খুব লজ্জা করছে। আমি তো কিছুই জিজ্ঞাসা করিনি। 
- না বাবা, এত বেলায় আর খাব না, অম্বল হবে। তুমি বরং চা খাওয়াতে পারো একটু?
উঠে গেলাম। গলার কাছে দলা পাকাচ্ছে। বললাম, "একটু বসুন।"
চা নিয়ে এলাম। 
- তোমার মা থাকলে এখন এই অবেলাতেও খাইয়ে ছাড়তো। বড় অদ্ভুত মানুষ তোমার মা। আমার কথা শুনে নিজেই কেঁদে ভাসালো এমন, যে আমিও কেঁদে ফেললাম। নিজের জন্য কাঁদতে তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমার মা-ই মনে করিয়ে দিলো। 
আমার কান্না পাচ্ছে। উঠে টয়লেটে গিয়ে ফিরে এলাম চোখেমুখে জল দিয়ে বিস্কুটের কৌটোটা নিয়ে। ভাতের খিদে বিস্কুটে যায় না জানি। মায়ের একবার খুব শরীর খারাপ হয়েছিল। দুপুরে ভাত হয়নি। বিস্কুট খেয়েছিলাম, পারিনি, গা গোলাচ্ছিল। ওই প্রথম ফ্যানভাত করতে শেখা। ওনার গা গোলানোর সময়টুকুও বোধহয় পেরিয়ে গেছে। 
বললেন, "রাতে খুব অস্বস্তি হত জানো, ভয় ভয় করত। তাও ভগবান জুটিয়ে দিলেন। একজন বিধবা মহিলা, আমার চেয়েও অভাগা, সাত কুলে কেউ নেই, ছেলেটা মরেছে ট্রেনে কাটা পড়ে। সে আমার সাথে শোয়, মাসে তিনশো টাকা দিই।"

মা ফিরলেন। কথা হল। মা রিকশা ডাকতে পাঠালেন। ডেকে এনে ওনাকে তুলে দিতে যাচ্ছি, মা বললেন, "কাল একবার ঘোষবৌদির বাড়ি আসবেন, নারায়ণ পূজো আছে।"
কাকিমা রিকশায় উঠে বললেন, "হবে না গো, কাল একবার ছেলের ওখানে যেতে হবে। ওদের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, তা নাতিটা এত দুরন্ত যে কারোর কাছে থাকবে না, জানেন তো, আমাকেই গিয়ে সামলাতে হবে।" 
আমি আর শুনতে পারলাম না। ফিরে এলাম।
আজ ভাবি, সংসার যেদিন সৃষ্টি হয়েছিল, সেদিন থেকে অনেক কিছু পাল্টে গেলেও মায়ের জাতটা বোধহয় আর পাল্টালো না। সবকিছুর পর তাই হেরে যেতে হয়, এই অবোধ, অবুঝ, শেষ আশ্রয় মায়ের জাতটার কাছে। ঈশ্বরও তাই নিশ্চিন্তে আড়ালে থেকে দিবানিদ্রা দিতে পারেন, সংসার 'মা'-শূন্য হয়নি যে।