সৌরভ ভট্টাচার্য
7 July 2019
প্রিয় মানুষ আমার,
এখন অনেক রাত। বাড়ির সবাই ঘুমিয়েছে। আমি তোমায় লিখছি। তোমার কাছে আমার এ লেখা পৌঁছাবে - সে কারণে লিখছি যদি বলি তবে সবটা সত্যি বলা হয় না। আমি লিখছি কারণ এই লেখার সময়টুকু আমি তোমার সাথে একান্তে থাকতে পারি। শব্দের শরীরে নিজেকে দেখতে পাই।
আমার সংসারে তোমার জন্য জায়গা নেই। আসলে আমার সংসারে কিছু বাড়তির জন্যই জায়গা নেই। আমার হৃদয়টার মত উদবৃত্ত আমার সংসারে আর কিচ্ছুটি নেই। তবু তো সে আছে বলো। জবাফুলের বৃন্তের উপরে উপপত্রের বৃন্ত হয়, তার বিশেষ কোনো কাজ আছে কিনা জানি না, কিন্তু প্রকৃতির খেয়ালে তবু সে আছে। আমার হৃদয়টার মত, খেয়াল বলতে পারো।
আমি তোমায় স্বীকার করেছি। কিন্তু গ্রহণ করতে পারি না। কেন পারি না, প্রশ্ন কোরো না। উত্তরটা আমরা দুজনেই জানি। উত্তরটা রূঢ়। সমাজে অন্যায় - অপরাধ আর পাপের মধ্যে পার্থক্য আছে। অন্যায় অপরাধ মানুষ সমাজের বানানো নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে করে। পাপ করে মানুষ নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে। তুমি আমার সমাজের শাসনে পর, তাই আমার ঘরে বসার সময় তোমার ফিরে যাওয়ার তাড়াকে আমি অত্যাবশ্যক হিসাবেই দেখি, সত্য হিসাবে নয়। তুমি ফিরে যাও, যেতে হয় বলেই, যেতে চাও বলে তো নয়!
তোমায় আমি পাব না কোনোদিন। যে ভাবে শিকড় একটা ফুল-ফল-পাতা সব কিছু নিয়ে গাছটাকে পায়, সেভাবে কোনোদিন পাব না। তার যন্ত্রণা আছে, হতাশা নেই। ফুলের সৌরভ যেমন বাতাসকে পায় তেমন ভাবে তো পাব! বাঁধন থাকবে না, মাধুর্য থাকবে। হোক না সে মাধুর্য অসম্পূর্ণ, তবু খাঁটি তো! তোমায় পেয়েছি বলে নিজেকে ঠকাবো না কোনোদিন, তোমায় পেলে কি কি হতে পারত ভেবে ভেবে রাতগুলো অসহ্য করে তুলব না আর। এই কথাটা স্বীকার করে নিলাম। সত্যকে স্বীকার করে নিলে হাঁটার একটা সরু পথ হলেও পাওয়া যায়। মিথ্যার রাজপথ কুয়াশার মত মিলিয়ে যায় আচমকাই।
তোমার কক্ষপথ আমার কক্ষপথের দূরত্ব কত জানো? কয়েক জন্মের। তবু প্রদক্ষিণ করার কেন্দ্রবিন্দুটা এক। তুমি জানো, আমিও জানি। তুমি যদি জিজ্ঞাসা করো, এর পরিণাম কি তবে? আমি বলব জানি না। পরিণাম খুঁজব এতটা অসহনীয় হওনি তুমি। বরং যেমন চলছে চলুক। যাদের চলার সুখ নেই, তাদেরই গন্তব্যে পৌঁছে চলাটাকে শেষ করে দেওয়ার তাড়া থাকে, আমার সে নেই। তুমি তুমিই থেকো। আমি আমিই। মিথ্যা যেন না থাকে। সত্য খণ্ডাংশের স্থান দিলেই যেন মাথা পেতে নিই, পূর্ণ সত্য নাই বা পেলাম। শূন্যতা যন্ত্রণার নয়, শূন্যতাকে ঘিরে ঘিরে কান্নাটাই যন্ত্রণার। সেটা আর না হোক।
ইতি,
আমি
চিঠিটা টেবিলের উপর রাখা। মানুষটা ঘুমিয়ে টেবিলে মাথা রেখে। জানলা খোলা। দক্ষিণের বাতাস এসে চিঠিটা দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। মাঠের মধ্যে কয়েক পাক ঘুরে চিঠিটা পুকুরের জলে গিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল। হাতে খোলা পেন। চিঠিটা? মনেই পড়ল না, সত্যি লিখেছিলাম না লিখব ভেবেছিলাম?
সংসার জেগে উঠল। সাথে কর্তব্যও। সারাদিন ঘুরেফিরে মানুষটা ভেবে চলল, চিঠিটা কি সত্যিই লিখেছিলাম, না স্বপ্ন ছিল?