Skip to main content
 
 
সারারাতব্যাপী উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের অনুষ্ঠান। পুরিয়া, ইমন, বেহাগ, কলাবতী, কানাড়া, বাগেশ্রী, মালকোষ, ললিত, ভৈরব হয়ে যখন অনুষ্ঠান শেষ হল, তখন পুবাকাশ ঈষৎ আলোকিত।
সবাই একে একে ফিরে গেল। আসন ফাঁকা। মঞ্চ ফাঁকা। সজ্জিত ফুল, মালা বাসি হতে শুরু করেছে। শুকিয়ে শ্রীহীন অনেকটা। টানটান করে রাখা গালিচা কুঁচকে মঞ্চের উপর। শ্রোতাদের চেয়ারের পাশে কাগজ, ভুলে ফেলে যাওয়া রুমাল কোথাও কোথাও। যে রুমালে চোখের জল মোছা হয়েছে হয়ত দরবারি কিম্বা বেহাগের আঘাতে। 
একজন বসে চেয়ারে। যে কুকুরগুলোকে কর্তৃপক্ষ জোর করে সারা সন্ধ্যে আটকে রেখেছিল তারা ছাড়া পেয়ে পাগলের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে চেয়ারের গন্ধ শুঁকে শুঁকে, ঠোঙা উল্টিয়ে খাবার খুঁজে খুঁজে। বসে থাকা লোকটার ময়লা ধুতির কোনাও শুঁকে গেল। লোকটা নিরুত্তাপ। চোখদুটো বিস্ফারিত, মঞ্চের দিকে তাকিয়ে বসে।
 
ঝাড়ুদার এলো। তিরপলের মালিক এলো। ঝাড়ুদার এসে বলল, দাদা উঠবেন না? 
মানুষটা মাথাটা উঁচু করে ডান দিকে প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে তাকালো। বলল, তুমি কাল গান শুনতে এসেছিলে?
লোকটা খানিক বিরক্ত হয়ে বলল, আমি! খেপেছেন! এইসব গান আমি শুনিনা। ওঠেন ওঠেন, মেলা কাজ আছে। 
মানুষটা বলল, সামনের চেয়ারটায় বোসো। 
লোকটা কি বুঝল, বসল।
মানুষটা জিজ্ঞাসা করল, কি করো?
লোকটা বলল, ঝাড়ু দিই।
কাউকে ভালোবাসো?
ঝাড়ুদার একটু থেমে, কিছু একটা ভেবে বলল, না। 
মানুষটা ঝাড়ুদারের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল। মুহূর্তে ঝাড়ুদার তার শূন্য ঘরটায় ঘুরে এলো।
মানুষটা বলল, আমিও না।
ঝাড়ুদার বলল, পেট আর পেটের নীচেই বাঁচি, বুকটা শুকনো।
মানুষটা বলল, আমার মধ্যে ঈশ্বর ছিল, মরে গেছে। বাঁচাবার চেষ্টা করলাম কত, কই বাঁচলো!
ঝাড়ুদার চুপ। মানুষটা চুপ। কুকুরগুলো ঘুমাচ্ছে। তিরপলের লোকেরা আধশোয়া হয়ে বিড়ি খাচ্ছে, গল্প করছে।
 
ঝাড়ুদার বলল, মনটা খারাপ করে দিলেন। সকালে ওসব বিষ গিলি না, কিন্তু আজকে....
চলো আমিও গিলি আজ... সুরে যখন মাতাল হলাম না, শুঁড়িখানায় দেখি....
ঝাড়ুদার উঠে দাঁড়ালো। মানুষটা উঠে তার সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে ভৈরবীর একটা তান গুনগুন করতে লাগল। ঝাড়ুদার বলল, বেশ গলা তো...
রাস্তায় তখন ব্যস্ততা। যদিও রবিবারের সকাল, তবু ছুটাছুটি শুরু। মানুষটা ঝাড়ুদারের কাঁধে হাত রেখে বলল, আমার কাছে টাকা নেই কিন্তু ভাই।
ঝাড়ুদার বলল, সে হোক। আমি তো আছি!
কথাটা শুনে দু'জনেই চমকে উঠল। যে বলল আর যে শুনল --- দু'জনেই, আমি তো আছি!
তারা সেইখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কতক্ষণ কেউ জানে না। তারাও না। ততক্ষণে কুকুরগুলো জেগে গেছে। তিরপল খোলা হয়ে গেছে। বাসিফুল গঙ্গায় ভেসে গেছে। মানুষ দু'জন আর শুঁড়িখানায় গেলো না। ঝাঁট দিল ঝাড়ুদার। গান শোনালো আরেকজন মানুষ।