শপিংমলে থিকথিক করছে ভিড়। সন্ধ্যেবেলা। পেমেন্টের লাইনই চার পাঁচটা। একটা অবাঙালী পরিবার। হিন্দিভাষী। হিন্দিটা শুনলে ছত্রিশগড়ের মানুষ মনে হয়। ভদ্রলোকের বয়েস চল্লিশের একটু উপরে। ভদ্রমহিলার তিরিশের আশেপাশে। সালোয়ার কামিজ পরা শীর্ণ শরীরটায় যেন ভার বহনের আর শক্তি নেই। চোখ দুটো কোটরে। একটা বিপন্নতা আর উদ্বেগ মিলেমিশে চাহনি।
সাথে তিনটে বাচ্চা। বড়টা মেয়ে, তার থেকে ছোটো একটা ছেলে, পিঠোপিঠি, সাত-আট হবে বয়েসে। আর কোলে একজন। কোলের জন বেশ দুরন্ত। চোখে মোটা কাজল।
ভদ্রলোক ক্যাশ কাউন্টারের কাছে পৌঁছালেন। ভদ্রমহিলা বাচ্চাগুলোকে সামলাতে সামলাতে পাশেপাশে এগোচ্ছেন। খুব যে সচ্ছল অবস্থা তা হয়ত নয়। তবু খুব খারাপও নয়।
হঠাৎ বাচ্চাটা একটা প্লাস্টিকের খেলনা তুলে নিল হাতে। পাশেই রাখা ছিল। ভদ্রমহিলার চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠল আতঙ্কে। বারবার ওর হাত থেকে খেলনাটা কেড়ে স্বস্থানে রাখতে চাইছেন, কিন্তু বাচ্চাটার চীৎকারে আর জেদে পারছেন না। আরো কিছুও নিশ্চই আটকাচ্ছিল। না তো ওইটুকু প্রাণের কতই আর শক্তি। একটা থাপ্পড় কিম্বা একটা হ্যাঁচকাটানেই ও আত্মসমর্পণ করতে পারে কেঁদেকেটে ওর মায়ের কাছে।
কিন্তু না, মায়ের সাথে যেন ওর সমানে সমানে যুদ্ধ। বাচ্চাটার চীৎকার ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অরিজিতের গলায়। দিদিটা ভয়ার্ত চোখে মায়ের ওড়নার আঁচলটা ধরে চিবাচ্ছে। একবার মায়ের কোলের ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার পিছন ফিরে থাকা বাবার দেহের অঙ্গভঙ্গির দিকে। মাঝের ভাইটা ট্রলিতে সাজানো সস্তার জিনস তুলে তুলে দেখছে আর রেখে দিচ্ছে। একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি।
দিদিটা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাইকে চোখ বড় বড় করে শাসন করার চেষ্টা করল। মায়ের মুখে অসহায় বেমানান প্রশ্রয়ের প্রসন্নতা বারবার একটা আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কায় মুখ থুবড়ে পড়ছে। দিদি বকল, "রাখ দো ভাইয়া...চকোলেট লোগে..."... মা অসহায়ের মত এর ওর দিকে তাকাচ্ছে শপিং মলে। প্রস্তুতি নিচ্ছে, উপার্জন ক্ষমতাহীন মেয়েমানুষের বড়লোকি মাতৃস্নেহের দাম চোকানো ভর্ৎসনা আর অপমানের জন্য। বাপ দাদার ঘাড় থেকে নেমে বরের ঘাড়ে চড়ে খাওয়া মেয়ে মানুষের শখ!
স্বামী টাকা মিটিয়ে ফিরতেই, চূড়ান্ত ভয়ে আতঙ্কে, ভদ্রমহিলা অত্যন্ত অপরাধীর মত বললেন, "ছোট্টু নে ইয়ে লি"...দিদিটা বিস্ফারিত চোখে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে, ভদ্রমহিলাও। ভদ্রলোক ঈষৎ বিরক্ত হয়ে হাত থেকে খেলনাটা নিয়ে কাউণ্টারে বললেন, "ইয়ে কিতনে কা হ্যায়?"...
আমি অত খুশী মায়ের চোখ কম দেখেছি। যেন হাতে চাঁদ পেল। বাবা খেলনাটা বাচ্চাটার হাতে দিল। মা বাচ্চাটাকে চুমু খেয়ে নিজের কঙ্কালসার গালে কাজল মাখল। দিদি মেজো ভাইয়ের সাথে না কেনা জিনস দেখল। আমি বেরিয়ে এলাম। বন্ধুর কাজ হয়ে গেছে। আমারও। পিছনে অরিজিতের গান। চীৎকার। উল্লাস। আমার চোখে দুটো বিস্ফারিত চোখ। পক্ষীশাবক আগলে রাখা জীর্ণশরীরে নীড়ের পাশে বসা দুটো চোখ।