রমজানের হাতে কড়া। তাও মাথায় বিলি কেটে দিলে ভালোই লাগে পরাশরবাবুর। রমজান বছর দশেক আগে পরাশরবাবুর বাগানের কাঁঠাল গাছে গলায় দড়ি দিয়েছিল। কেন দিয়েছিল কেউ জানে না। সে অকৃতদার ছিল। গরীব মানুষ, পরাশরবাবুদের বাড়িতেই ফাইফরমাশ খেটে দিন চলে যেত। তাকে অবশ্য হাসতে দেখেনি কেউ কোনোদিন। গায়ের রঙ তামাটে, রোগা-বেঁটেখাটো শরীর, তবে খাটতে পারত। পরাশরবাবুর স্ত্রী বেঁচে থাকাকালে অনেকবার তাকে বিয়ের কথা বলেছেন। রমজান কানে নেয়নি। এক মহালয়ার ভোরে তার ঝুলন্ত দেহ দেখে পরাশরবাবু নিজেই মর্নিং ওয়াকে যাওয়ার সময়।
বারাসাতের এদিকটা বেশ গ্রাম গ্রাম এখনও। পরাশরবাবুর পুরো পরিবার থাকে এন্টালিতে। তিনি তার পৈতৃক কাঠের ব্যবসা দুই ছেলের হাতে দিয়ে এই গ্রামে তাদের পুরোনো বাড়িতেই কাটিয়ে দেবেন মনস্থ করেছেন। আগে ভেবেছিলেন তীর্থ করবেন। কিন্তু মনোরমা আচমকা মারা যেতে সে ইচ্ছা তার ভিতর থেকে একেবারেই চলে গেল।
গ্রামের বাড়িটা দোতলা। নীচে একটা হলঘর, একটা বাথরুম আর রান্নাঘর। উপরে তিনটে হলঘর আর বাথরুম দুটো। বাড়ির সামনে বিরাট বাগান। বাগানের পূর্বদিক মুখ করে একটা শিব মন্দির – জলেশ্বর। পরাশরবাবুদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি নেই। রমজানের মন্দিরের কাজেও কোনো বিধি-নিষেধ ছিল না। রমজান মনমরা থাকত সব সময়। এটার কারণ কেউ জানে না।
সেদিন পূর্ণিমা। পরাশরবাবু ছাদে আরামকেদারায় বসে। সামনে সবুজ মাঠ চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। রাত হয়েছে, দূরে বাড়ির জানলাগুলো আলোর বিন্দু বিন্দু লাগছে। পরাশরবাবুর গড়গড়া সেজে এনে দিয়ে গেল রতন। পাশেই বাড়ি, বছর তিরিশ বয়েস হবে, নতুন কাজে এসেছে, এর মধ্যেই বেশ বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে পরাশরবাবুর। রমজান রাত বারোটা না পেরোলে আসতে পারে না। নাকি আসতে চায় না ঠিক জানেন না পরাশরবাবু।
শীতটা চলে যাব যাব করছে। একটা ঠাণ্ডা আমেজ আছে বাতাসে। পরাশরবাবুর স্মৃতি অতীতের অলিতে-গলিতে অকারণেই উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ ঘট্ করে আওয়াজ হল। পরাশরবাবু মোবাইলটা অন্ করে দেখলেন বারোটা তিন। রমজান এসেছে। তার শরীরটা পুরো দেখতে পান না পরাশরবাবু। একটা কালো ধোঁয়ার মত মনে হয়, আর একটা অদ্ভুত গন্ধ। সে গন্ধটা ভালো না খারাপ বলা শক্ত। তবে এই জগতের যেন না গন্ধটা।
- হ্যাঁরে রমজান, তোর বৌদিমণিরে দেখতে পাস?
- না, সে অন্যলোক।
এই কথোপকথন আগেও হয়েছে বহুবার। কোনো ভাবের পরিবর্তন হল না তাই কারোরই।
- আচ্ছা তুই অমন একটা কাজ কেন করলি আজ অবধি বললি না, তুই কি কোনোদিনই বলবি না?
কোনো উত্তর নেই। মাথার উপর রমজানের ঠাণ্ডা আঙুল। বিলি কেটে দিচ্ছে। চাঁদের উপর একটা পাতলা সাদা মেঘ চাদরের মত ঢেকে। একটা প্যাঁচা ডাকছে সামনের বাগানে। দু'জনেই কেউ কোনো কথা বলছেন না। আসলে কিছুই বলার নেই।
- হ্যাঁরে রমজান, জীবন মানে কি বুঝলি তুই?
- বুঝিনি দাদা।
আবার সব শান্ত। হঠাৎ দূরে কোথাও নামসঙ্কীর্তনের আওয়াজ ভেসে এলো, বাতাসের সাথে এলো, আবার বাতাসের মোড় ঘুরতেই মিলিয়ে গেল।
রমজান বলল, ধর্মে আমার বড় ভয় দাদা।
পরাশরবাবু মুখটা ঘুরিয়ে তাকে বললেন, সামনে আয়, কেন ভয় রে?
পরাশরবাবু দেখলেন তার সামনে একটা কালো ছায়ার মত শুয়ে রমজান।
- উমারে আমার জন্যেই তো মরতে হল।
পরাশরবাবু কিছু একটা আঁচ পেলেন, আগের অলৌকিক গন্ধটা সরে একটা ঘামের গন্ধ আসতে শুরু করেছে।
রমজান বলে চলল, আমার তখন উনিশ বছর ওর আঠারো। হিন্দুর মেয়ে। আমরা পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। ওর দাদারা টের পেলে। আমাদের খুঁজে ধরে নিয়ে গেল। আমায় শাসিয়ে ছেড়ে দিল। উমা গলায় দড়ি দিল। আপনি বাংলাদেশ গেছেন?
- না রে।
- ইছামতীর পাড়ে দাঁড়িয়েছেন?
- হ্যাঁ, আমার মামাবাড়ি তো টাকিতেই।
- এদিকে ঈশ্বর ওদিকে আল্লা। আল্লাতালার বর্ডার হয়?
- তুই কি তাই...
- না গো, আমি তো দেশ ছেড়ে এদিকে চলে এলাম... ভুলেও গিয়েছিলাম... তারপর...
- কি তারপর রমজান? পরাশরবাবুর গলায় কোন অতলান্ত স্নেহের সুর।
- সেদিন টিভিতে দেখালো, একজন গরুর মাংস নিয়ে যাচ্ছিল বলে তাকে পিটিয়ে মেরেছে...
পরাশরবাবু চমকে উঠলেন, হ্যাঁ...
- আমার মনে উমা ভর করল, সে বলল, পৃথিবীতে থেকো না আর, চলে এসো, ওটা নোংরা জায়গা, আমার মত তোমাকেও মরতে হবে...
পরাশরবাবু চুপ।
- তাও সহ্য করেছিলাম। তারপর শুনলাম, আমাদের শহরের বাড়ির কিছুটা দূরে রামমন্দির বনানো নিয়ে কি সব মারামারি হয়েছে হিন্দু-মুসলিমে, আমার মনটা বিষিয়ে গেল। আমরা গ্রামের মূর্খ মানুষ, লেখাপড়া জানি না এই সব করে কাটে, শহরেও কি করে এই বিষ ঢোকে দাদাবাবু? আপনি ক'দিন পরেই বললেন এই গ্রামের বাড়িতে এসে উঠবেন। তাই এলাম আমরা। আপনাদের শহরের বাড়ির পূজোর জোগাড় আপনি, বৌদিমণি করতে দিতেন, এখানেও শিবের মন্দির আমিই পরিষ্কার করতে শুরু করলাম। আপনাদের গ্রামের একজন মোড়ল আমায় ডেকে বললেন আলাদা করে, তুই যদি হিন্দুর মন্দিরে ঢুকিস তবে গ্রামের লোক আচ্ছা ব্যবস্থা করবে তোর, আপনি খুব বড় মানুষ তাই আপনাকে এসব বলার সাহস নেই নাকি ওদের, তাই আমায় শাসিয়ে গেল।
পরাশরবাবুর কথা আসছে না মুখে। গ্রামের বাতাসে একটা পরিবর্তনের ছোঁয়া গ্রামে পা দিয়েই টের পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন যেন সেই পরিবর্তনের একটা ভয়ংকর রূপ তার সামনে। আতঙ্ক লাগছে।
- তাই তুই...
- হ্যাঁ দাদাবাবু, কি হবে এ ধর্মের কোন্দলের মধ্যে থেকে, মরা মানুষের কোনো ভেদাভেদ নেই। তাই উমার কথাই মেনে নিলাম...
পরাশরবাবু চুপ করে আছেন। ওপার বাংলায় সদ্য ঘটা কিছু হত্যালীলার কথা মনে এলো। এমন জ্যোৎস্না পাংশু লাগছে তার কাছে এখন। সামনে রমজান শুয়ে। একটা কালোমেঘ আকাশের পশ্চিমদিক থেকে উঠে আসছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। হাওয়ার বেগ অল্প অল্প করে বাড়ছে। সামনের বাড়িগুলোর আলো নিভে গেছে। ঘুমাচ্ছে সব। পৃথিবীর অর্ধেক অন্ধকার, অর্ধেক আলো। এটাই কি রহস্য জীবনের? পুরো আলোকিত জীবন বলে কি কিছুই হয় না? মানুষ একা থাকলে তার কিসের ধর্ম? মানুষ জোট বাঁধে বিশ্বাসের ভিত্তিতে। সে রাজনৈতিক হোক কি ধর্মের। যুক্তির কোনো জোট হয় না। তবে মানুষ তো শুধু যুক্তিও নয়, তার বিশ্বাস থাকবে, রুচি থাকবে, প্রবণতা থাকবে। বিশ্বাস থাকলেই বিদ্বেষ জন্মাবে, যদি সে বিশ্বাস ভালোবাসায় সিক্ত না হয়। ভালোবাসা বিরুদ্ধের মধ্যে সামঞ্জস্য আনে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এসব চিন্তাই ব্যর্থ। কারণ ক্ষমতার লোভে মানুষ চিরকাল সাধারণ মানুষের মধ্যে বিবাদ ঘটিয়েছে। নিজেদের মধ্যে লড়লে ব্যস্ত থাকে মানুষ। সাধারণ মানুষের অক্ষমতাই হল সে বিচ্ছিন্ন, বিবেক-বিচারে অধীনস্থ থাকতে চায়। কিন্তু চিরকালই কি তা চায়?
ভোর হল। রতন এসে দেখল বাইরের দরজা হাট করে খোলা। চুরি হয়েছে? আতঙ্কিত হয়ে বাড়ির এ ঘর সে ঘর ঘুরে ছাদে এলো। পরাশরবাবু আরামকেদারায় শুয়ে। এক ঝলক দেখে রতন চায়ের জল চাপালো। চা নিয়ে এসে পরাশরবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল মণিদুটো স্থির, উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে। পরাশরবাবু ভোর চারটের আগেই মারা গেছেন, ডাক্তার এসে বলল।