Skip to main content

আমাদের কোথাও যেন থামার নেই। এই চক্রের হাত থেকে যেন কেউ আমাদের রেহাই দিতে পারে না। বারবার ইতিহাস আমাদের ধর্মের গোলকধাঁধায় এনে ফেলবে, বারবার আমরা রক্তারক্তি করব, বারবার আমরা কিছুটা সামনে এগিয়ে নব উদ্যমে নতুন ব্যাখ্যায় আবার পিছিয়ে আসব --- এই খেলা থেকে আমাদের রেহাই কেউ দিতে পারবে না।
       সংহতি ও বিদ্রোহ --- দেশের দুই অবস্থানই সত্য। কিন্তু সংহতি ও বিদ্রোহ --- এই দু-এর মধ্যে একটা খাঁটি কথা থাকতে হয় --- সত্য। সত্য কি? যা মিথ্যা নয়, মুখোশ নয়, মতলব নয়, স্বার্থনিমিত্ত ফাঁদ নয়, কপটতা নয়। সত্য মঙ্গলের সহায়। কিন্তু যেখানে শুধুই তাণ্ডব, শুধুই ক্ষয়ক্ষতি সেখানে ধৈর্য, স্থৈর্যর অভাব বুঝতে হবে। অর্থাৎ কিনা 'হাল্লা বোল'। যখন উন্মত্ততা, ক্ষেপিয়ে দেওয়া, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করাই লক্ষ্য, তখন বুঝতে হবে বড়সড় একটা প্রশ্নকে ফাঁকি দিয়ে, হইহট্টগোলের ধুলোর আড়ালে সরিয়ে দিয়ে কেউ কেউ যেন "মামাবাড়ি আগুন লেগেছে"-র গল্পের দিকে নিয়ে যেতে চায়।
       গত পরশু থেকে যোধপুর এক্সপ্রেসে। আজ সকালে এসে নামলাম। সারাটা ট্রেন খবর পাচ্ছি কি হচ্ছে চারদিকে। আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবদের উদ্বিগ্ন ফোন পাচ্ছি। হত্যালীলার কথা শুনছি। কেউ বলছেন, ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। কেউ বলছেন, গুলি করে মারতে পারে। কারা? সে প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর নেই। কারণ আমার টাকায় তৈরি, আমার টাকায় চলা সরকারি সম্পদ ভাঙার মধ্যে যে আমার কোনো গৌরব নেই, আমার মত হাজার হাজার সাধারণ মানু্ষের প্রাণ বিপন্ন করে যে আদতে ধোঁয়াশাই সৃষ্টি হয়ে চলেছে --- সে কথা বোঝার সময় কারোর নেই।
       শাসকের দিক থেকে বলা হচ্ছে নতুন নিয়ম, নাগরিকত্বের নতুন পরিচয়। কিন্তু তার মধ্যে কোথাও একটা জুজু লুকিয়ে আছে যেন অনেকেই সেটা টের পাচ্ছেন। বহুদিন ধরে প্রতিবেশী দেশ থেকে বহু মানু্ষ নানা উপায়ে এ দেশে এসে বাস করছেন - এ কথা আমরা সবাই জানি। তারা কি পদ্ধতিতে নিজেদের এই দেশের নাগরিক প্রমাণ করতে চাইছেন, সেও সুবিদিত। তার কোনোটাই সৎ, স্বচ্ছ উপায়ে নয়। তারা পড়েছেন এক যাঁতাকলে। না পারছেন জন্মসূত্রে প্রাপ্ত স্বদেশে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে, না পাচ্ছেন এ দেশে সসম্মানে মাথা উঁচু করে বাঁচার কোনো স্বচ্ছ উপায়। কোথায় থাকবেন তারা তবে? ক্যাম্পে? শরণার্থী হয়ে? এ দেশের নাগরিকত্ব কি ন্যায্য পথে পাওয়ার অধিকার নেই তবে তাদের?
       এই বিল কি সেই চিরকালীন আমাদের অবহেলা করে রাখা সমস্যার কথা ভাবছে? সমাধানের পথ দিচ্ছে? নাকি শুধুই বিশেষ ধর্মের উপর বিমাতাসুলভ আচরণের জন্য উদগ্রীব? যারা বিদ্রোহ করছেন তাদের উদ্বেগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে। সে ভাবনা অমূলকও নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অপরপক্ষের নিদারুণ অমানবিক অবমাননাকর জীবনযাপন প্রতিবেশী দেশে, গোপনে সে দেশ ছেড়ে এ দেশে এসে আশ্রয় নেওয়া নানা গোপন অস্বচ্ছ কৌশলে --- এ বিষয়ে এত নীরবতা কেন তবে? তাদের হয়ে কে কথা বলবে? তাদের পাশে কে দাঁড়াবে?
       তবে এর অর্থ এ অবশ্যই নয়, একজনের জন্য রাস্তা খুলে দিতে হলে আরেকজনের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে। বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গাদের নিজেদের মাটিতে থাকার স্থান দিয়েছে, ও নানা 'ন্যায্য' কারণে ভারত উদাসীন থেকেছে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে, তখন আমাদের বুদ্ধিজীবীমহলের নিষ্ক্রিয়তায় এ বোঝা গিয়েছিল যে আমাদের উদ্বেগ ভৌগলিক সীমাস্থিত মানুষের জন্য। যাদের আমরা "আমাদের" বুঝি। আমাদের উদারতা ততটাও স্ফীত নয়, কারণ আমাদের ব্যাখ্যায় আমাদের অতটা ধারণ ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ, আমাদের উদারতা একটা অনির্দিষ্ট অস্পষ্ট ভাবরেখায় নির্মিত। কেউ কেউ বিদ্রোহে এক, কেউ কেউ সংহতিতে এক। ভারত যখন সদ্য স্বাধীন হল, যখন নানা অঞ্চল স্বাধীন সত্তা চাইছিল তখন সদ্যজাত প্রতিবেশী দেশ থেকে ভাঙনের জন্য উস্কানি এসেছিল সব চাইতে বেশি। প্যাটেল কিভাবে সামাল দেন সে ইতিহাস। অন্য গল্প।
       আজ আবার একটা সঙ্কটময় মুহূর্ত। না গান্ধী, না রবীন্দ্রনাথ, না সুভাষ। এই তিনজন দেশনায়কের বিশেষত্ব ছিল এরা প্রত্যেকে নিজের ধর্মটা ভালো করে বুঝতেন। তাই অন্যকে সঙ্কীর্ণ করে স্বমত স্থাপনের ক্ষুদ্রচেষ্টা কোনোদিন করেননি। অন্যের অপর ধর্মটির উপর সহিষ্ণু ছিলেন বললে ছোটো কথা বলা হয়, বলা যায় সে ধর্মেরও সমঝদার ছিলেন, শ্রদ্ধা করতেন।
       আজ মুশকিল হল গভীরে গিয়ে কারোরই জানা নেই কোন ধর্মের মূল কথাটি কি। বাহ্যিক নানা আচার-অনুষ্ঠান-স্থাপত্য-পোশাক-খাদ্যকেই 'ধর্ম' বলা হচ্ছে। এমনকি ভাষাও যেন ধর্মের দাস --- সংস্কৃত ও উর্দু। তবে ধর্ম কি? এর কোনোটাই নয়। ধর্ম তাই যা মানুষকে সৎ, উদার, সাহসী করে। বহুর মধ্যে 'এক'-এর প্রতি বিশ্বাস এনে দেয়। বাকিটা তো লোকাচার, সংস্কৃতির অঙ্গ। কিন্ত এ পার্থক্যটুকু বুঝতে পারে এমন মানুষ সামনের দিকে কই? সেই অজ্ঞতাই আমাদের রাহু। বারবার এসে সামনে দাঁড়ায়। আমরা আমাদের অগ্রজদের ভুলি। কুঠার হাতে বেরোই। বিভাজনরেখা টানার ভয় দেখাই, আতঙ্কিত করি, কাজ গোছাই।
       ভারত একদিন বিভাজিত হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতেই। তাই এ সমস্যা রাজনীতি, শিল্পনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য --- সব কিছুকেই প্রভাবিত করেই চলবে। কারণ আমাদের মূলে বিশ্বাস --- আমরা 'আলাদা' বলেই আমরা আলাদা হয়েছি। মুশকিল হল যারা এই দুই 'আলাদা' দেশে সংখ্যালঘু। তারা হয়ে রইল তুরুপের তাস, শাটল কক। এসো লোফালুফি খেলি। এসো কাতুকুতু দিই। এসো ব্যবস্থার মধ্যে অব্যবস্থা এনে অক্টোপাস হই। কারণ, আমাদের ভাষার অক্ষর-ব্যাকরণ-উচ্চারণ-শব্দমালা মানে ধর্ম; আমাদের সাজপোশাক মানে ধর্ম; আমাদের খাদ্যতালিকাস্থ পশু-পাখি-শাক-সব্জী মানে ধর্ম; আমাদের পুর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ মানে ধর্ম; আমাদের আচার-আচরণ, সামাজিক নিয়ম, জন্মমৃত্যু ঘিরে যা চলে সবটুকু ধর্ম, শুধু ধর্মটাই ধর্ম নয়। সে সব মহাপুরুষের দায়। যেন এক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র রসায়ন বিভাগের পরীক্ষাগারকে বলে না পরীক্ষাগার। তার কাছে পরীক্ষাগার, পোশাক, কলকব্জা, নানা যন্ত্রপাতি সব পদার্থবিজ্ঞান, শুধু পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো ছাড়া। যেন এই সব আয়োজন তার সে সবের উপরেই দাঁড়িয়ে তার মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব। যেন তার পরীক্ষাগারটা ভেঙে পড়লে সব সূত্রগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে। এমনই মূঢ়তা আমাদের। এমনই আশ্চর্য মূঢ়তা! সেই মূঢ়তাতেই আমাদের ঘরে ঘোঘের বাসা। শয়তান সেই ঘোঘ নয়, শয়তান আমাদের নিশ্চেষ্ট, আত্মজ্ঞানহীন, অলস, অনুকরণপ্রিয়, পরাধীন সত্তায় থাকার ও অন্যকে রাখার মধ্যযুগীয় মনোবৃত্তি। তাই শক্তির সাধন নেই বলে বল্গাহীন শক্তি আমারই উন্মত্ততায় আমাকে অকালে নাশ করে। তারা অলক্ষ্যে হাসে। আমরা আমাদের কণ্ঠস্বরের তীক্ষ্মতায়, উন্মত্ততার প্রবলতায় আত্মতুষ্টিতে আমোদিত হয়ে, স্বকর্তব্য সমাধা হয়েছে ভেবে নিদ্রায় যাই। ওদিকে ওদের কাজ সম্পন্ন হয় সুচতুরতায়।