কানাই গাইয়ে ফিরছে। বুকের কাছে দলা পাকানো অভিমান, কান্না। আজ সুর লেগেছে, সুর জাগেনি। না বেহাগে, না শিবরঞ্জনীতে।
রাত তো অনেক। গ্রামের ফাঁকা রাস্তা। মাথার উপরে বাঁকা একফালি চাঁদ। রাস্তার দু ধারে মাঠ। কেউ তার সঙ্গে ভালো করে কথা বলছে না। কানাই সাইকেল থেকে নামল। সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে রাস্তার পাশে বসল। গলাটা অল্প অল্প ব্যথা করছে। তার বয়েস কত হল? সামনের অক্টোবরে বত্রিশে পড়বে। কিন্তু এখনও নিজের মন বসল না। গোটা জীবনটাই ছড়ানো। গুরু বলেন, কানাই জীবনে কিছু দুঃখ গ্রহণ করে নিতে হয়, কিছু দুঃখকে বরণ করে নিতে হয়। নইলে জীবন চাষবাসহীন ক্ষেতের মত পড়ে থাকে। সে অভিশাপ।
কানাই জীবনে বড় দুঃখ, ছোটো দুঃখ দুই-ই পেয়েছে। গুরুর কৃপায় জীবনের হাত ধরে সে সব সইতেও শিখেছে। কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে একটা শূন্যতা। যে সুর সে গলায় আনতে চায়, সে সুর মাথায় জন্মালেও গলায় আসে না কেন? অঞ্জলির মত করে প্রতিটা দিন নিজের সাধনাকে পরমের পায়ে দেয় তো, তবু কোথায় যেন খামতি থেকেই যায়।
অহংকার না গেলে বড় শিল্পী, জাত শিল্পী হওয়া যায় না কানাই - গুরুদেব বলেন। গুরু বলেন সুরের মধ্যে ডুবে অহং এর উৎস খোঁজ কানাই। অহং এর উৎস খুঁজে পেলেই সুরের বন্যা ডাকবে বুকে।
কানাই সুরে ডুবতে চায়। কিন্তু কিসে যেন আটকে যায়। আসলে তার মনে হয় তার যেন কোথাও একটা খ্যাতির লোভ আছে। সে চায় সবাই তাকে জানুক, তাকে ভালোবাসুক, শ্রদ্ধা করুক। কানাইয়ের হাত থেকে সুরের খেই যায় হারিয়ে। সে ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়। শান্ত না হলে সুরের বুকে সুর জাগে না। কিন্তু শান্ত কি করে হবে সে? আবার গুরুদেবের কথা কানে আসে, তোর অহং এর উৎস খোঁজ কানাই।
কানাই বাবু হয়ে বসল। মালকোষ ধরল। সুর তাকে তার অহং এর উৎসের কাছে নিয়ে আসুক না হয়। আজ তো কোনো শ্রোতা নেই। কিন্তু গাইতে গাইতে সে টের পেল তার মধ্যে জাগছে এক বিচারক। না, বিচারকের ছদ্মবেশে এক সুক্ষ্ম অহং, সে বিচার করছে না, সে তুলনা করছে। সে বলছে কানাই, এই দেখো, এই জায়গাটা তো অমুকের মত হল না। এই দেখো, এই মীড়টা তো তমুকের মত হল না। ক্ষত বিক্ষত করছে কানাইকে। না, কানাইকে না, কানাইয়ের মালকোষকে। ক্রমশ কানাই দেখতে পাচ্ছে, মালকোষের আত্মা মালকোষকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পড়ে থাকছে শুধু কয়েকটা সুর। যা শুধুই শ্বাস। প্রাণ নেই।
কানাই কেঁদে উঠল। কি হবে এ প্রাণ রেখে? কানাই উঠে দাঁড়ালো। হাঁটতে শুরু করল। কিছুটা হাঁটলেই গঙ্গা। যাক প্রাণ। উৎস যদি নাই পায়, নিজেকে শেষ করে দিলেই তো সব যায়।
বেশ কিছুটা হেঁটেছে কানাই, হঠাৎ শুনল বাঁশির আওয়াজ। কি অপূর্ব! আহা, কে বাজায়?
কানাই সুর অনুসরণ করে এগোলো। শিব মন্দিরের চাতালে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে কেউ। অন্ধকারে ভালো বোঝা যাচ্ছে না। কানাই মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে। তার ভিতর থেকে সব অভিমান, ক্ষোভ গলে গলে যাচ্ছে। সে না চাইতেও তার পা এগোতে শুরু করল। যে চায় না বাধা পড়ুক তার সুরে। কিন্তু সে তো নিজেকে আটকাতেই পারছে না। সামনে এসে দাঁড়ালো। নিঃশব্দে বসল। চোখটা বন্ধ হয়ে গেল। নিজের ভিতরে পর্দার পর পর্দা সরে সরে যাচ্ছে। চিন্তাগুলো গোয়াল ঘরের গরুগুলোর মত ঘুমিয়ে পড়ছে একে একে। স্তব্ধ গোয়াল ঘর। সে গোয়াল ঘর পেরিয়ে গেল। সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে সব। এক উজ্জ্বল, শান্ত, শীতল আলোর বিন্দুতে মিশে যাচ্ছে যেন সব।
পাখির আওয়াজে চোখ মেলে তাকালো কানাই। তার সামনে ঘুমিয়ে আছে পাগল জগা। মাথার কাছে রাখা তার বাঁশি। দিনে যে পাগল, সে রাতে এমন বড় সাধক। সংসারে যে নির্ধন, সংসারের বাইরে দাঁড়িয়ে তার এত ঐশ্বর্য!
কানাই মাথা মাটিতে ঠেকিয়ে প্রণাম করল জগাকে। তার বাঁশিকে। ভোরের আলো এসে পড়েছে ধান ক্ষেতে। সূর্য উঠতে দেরি আছে। কানাই সাইকেলটা নিল। তার বুক ঠেলে উঠছে সুর। প্রভাতীর সুর। সে যেন বৈতালিক। তার ভিতরে জমে থাকা যুগান্তরের অন্ধকার ভেদ করে তার ঘুম ভাঙাতে কে যেন গাইছে প্রভাতী। কথাগুলো আবছা, সুরটা স্পষ্ট। কানাই সাইকেল থেকে নামল। রাস্তার উপর সাষ্টাঙ্গে শুয়ে প্রণাম করল। কাকে? জানে না। আবার জানেও যেন, এ বিশ্ব সংসারের যে গুরুদেব তাঁকে প্রণাম জানালো। জগার মুখটা ভেসে উঠল। কানে ভেসে উঠল গুরুদেবের গলা, সঙ্গ গুণে সত্য জাগে কানাই… সত্য আপনি আপনি কি জাগে?... সঙ্গলাভে সত্য জাগে… সঙ্গলাভে প্রেম… জীবন সঙ্গগুণেই স্বর্গ… চিত্ত সঙ্গগুণেই হেম।