খিচুড়ির পাতা নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে হীরু বারেবারে। হীরুর আঁচলটা পাতে পড়ছে দেখে বাড়ির গিন্নী বললেন, কি হল রে হীরু, কি ভাবতে বসলি খাবার মুখে করে? তোর ছেলেমেয়েদের জন্যে বেঁধে দিইচি তো রে।
হীরু চমক ভেঙে বলল, তা না গো বৌদি। মাথাটা কেমন ধরে আছে মনে হচ্ছে।
ঠিক আছে। আজ বাসনগুলো তোর ভাইবউ বরং মেজে দিক, তুই বাড়ি যা।
না থাক, পোয়াতি তো, ডাক্তার বেশি ঝুঁকতে বারণ করেছে গো... জানোই তো...আমিই করে যাব।
বাইরে জৈষ্ঠের রোদ। পাড়া গাঁ। দুপুর দুটো। আজ এই মুখার্জী বাড়িতে বিশেষ পূজো ছিল ধম্ম ঠাকুরের। এই মুখার্জী বাড়িতে একটা না একটা পূজো লেগেই থাকে। আজ শীতলা, কাল রক্ষাকালী, পরশু গুরুব্রত। হীরু কাজ করছে প্রায় ছ'বছর হল। হীরু ঝাড়গ্রামের মেয়ে। ওর স্বামী বলাই মিস্ত্রী ছিল। গত বছর ক্যান্সারে মারা যায়। হীরুর দুই ছেলে, এক মেয়ে। ওর বয়েস এই তিরিশের কোঠায় হবে। শক্ত-সামর্থ্য সে কোনোকালেই নয়, তবু চলেই যায়। এতগুলো বছর তো এই ক'টা হাড়েই টেনে দিল। বড় ছেলেটা এই চব্বিশে পড়ল। কাজে লেগে গেছে। পড়ল না। যা হোক পরের দুটোর পড়াশোনায় তবু নিষ্ঠা আছে। আর বকুর, মানে বড়ছেলেরই বা দোষ কি, এই বয়সে বাবা হারালো। মাথায় ছাতা ধরার তো কেউ নেই। যা সব কাকা-জ্যাঠাদের ছিরি!
কোনোরকমে খাবারগুলো গিলে এসে হীরু ঠাকুর ঘরের পাশের ঘরের মেঝেতে এসে শুলো। সবার খাওয়া হতে হতে এখনও দেড়-দু'ঘন্টা। একটু ঘুমিয়ে নিতে পারবে।
ঘরটায় পাখা নেই। হীরু আঁচলটাকে পেতে তার উপরে একটা হাত রেখে তাতে মাথা দিয়ে শুলো। ঘরের উপরে বড় তাক। ভরতি বাসন-কোসন। উত্তর দিকে একটা বড় জানলা। রোদ এসে ত্যারছাভাবে মেঝের ডানদিক ঘেঁষে পড়ছে। হীরুর চোখদুটো ক্লান্তিতে জুড়িয়ে আসছে।
হঠাৎ কারোর একটা ধাক্কায় চোখ মেলে তাকালো, বকু। ধড়মড় করে উঠে বসল, কি রে, তুই?
হ্যাঁ মা, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো, কথা আছে।
কিন্তু আমার কাজ আছে যে রে অনেক।
সে আমি মামীকে বলে ম্যানেজ করেছি, আর বুবু পিসী আছে তো, হয়ে যাবে। বুবু পিসী হীরুদের পাশের বাড়ি থাকে।
হীরু গিন্নীকে বলে বকুর সাথে বেরিয়ে এলো। বাড়ি আসতে আসতে যা শুনল তাতে তার হাড় হিম হয়ে গেল। একবার মনে হল পা-টা টলে গেল, বকু কোনোরকমে সামলে নিল। কিন্তু এটা কি করল বুচি? পালিয়ে গেল?
বুচি হীরুর মেয়ে। সবচেয়ে ছোটো। এবার মাধ্যমিক দিত। পালিয়েছে লাইনের ওপারের নাপিতের ছেলে বাপ্পার সাথে।
হীরু বাড়ির দিকে এগোতে এগোতে দেখে ভিড় জমে আছে। হীরুর বুকটা ধড়ফড় করে, মাথাটা টলতে থাকে, জিভ শুকিয়ে আসতে থাকে। এটা কি করল মেয়েটা। সে যেন এ সবের তালেগোলে ভুলেই গিয়েছিল বলাই মারা গেছে গত বছর। ভাবতেই তার মধ্যে একটা শূন্যতা আর সাহস একসাথে জন্মালো। ভেঙে পড়লে চলবে না। আগে গিয়ে ওই নাপিতের সাথে দেখা করতে হবে।
কি করে বাপ্পা? তোর বন্ধু না? আমাদের বাড়িতেও এসেছে তো, না?
বুকু অন্যদিকে ফিরে বলে, হ্যাঁ। তা কত লোকই তো আসে, তোমার মেয়ে যে এমন একটা কাণ্ড ঘটাবে কে জানত বলো? বুকুর গলায় ঝাঁঝ।
হীরু বুঝল, এটা ওর রাগ নয়। অভিমান, অসহায়তা। হীরু নিজেকে দেখে অবাক হচ্ছে, এত শান্ত কেন সে?
ঘরের মধ্যে এসে আবার শুয়ে পড়ল। বুকুকে বলল, সবাইকে এখন যেতে বল। বল মায়ের শরীরটা খারাপ। তারপর তুই দরজাটা দিয়ে আয়, বাচ্চু (ছোটোছেলে) এখনও স্কুল থেকে ফেরেনি তো? আজ কি বার? ও মঙ্গলবার, আজ তো পড়ে সেই ন'টা নাগাদ ফিরবে। হীরু নিজেকে দেখে সত্যিই অবাক হচ্ছে।
বাপ্পার ফোন সুইচ অফ্।
বুকু একটা টোটো ডাক।
টোটোতে বুকু আর হীরু পাশাপাশি বসল।
কত বছর আগের কথা। পঁচিশ না ছাব্বিশ? কে জানে? হীরু মাঠ থেকে বাবাকে খাবার দিয়ে ফিরছিল। তখনই রাস্তায় প্রথম দেখে বলাইকে, ঝাড়গ্রামে। সে তাদের হেড মিস্ত্রীর সাথে গিয়েছিল। বিয়েবাড়ি ছিল। সে বিয়েবাড়িতে হীরুদেরও নেমন্তন্ন ছিল। মদে চুর হয়ে বলাই তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। হীরুর প্রথমে রাগ হলেও পরে ভালোই লেগেছিল। কত কথা বলাই তাকে সে রাতে বলেছিল। বাবা-ই তো বলে মদ খেলে নাকি মানুষ শুধু সত্যি কথাই বলে। সে বলাইকে বিশ্বাস করেছিল। অবশ্য ঠকেওনি। বলাই সেদিন রাতেই ধানক্ষেতে নিয়ে গিয়ে তাকে...
বুকু আর কদ্দূর রে?
সে কি লেভেল ক্রসিং-এই তো পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকল, খেয়াল করোনি, কি একটা ভাবছিলে।
হীরু পুরো কথাটা শুনলো না বুকুর, আবার সে পঁচিশ বছর দৌড়ে চলে গেছে। ভোরের ট্রেনে সে পালিয়ে গিয়েছিল। আর যদি সে না পালাত? কি হত? ওই গ্রামের কোনো একটা পশুর হাতেই তো ওর বাবা তাকে তুলে দিত? যেমন মাকে দিত, মদের টাকা জোগাড় করবে বলে। কেন হরেন কাকা যখন তার বুকের উপর কামড়ে দিয়েছিল, বাবা কি বলেছিল? বলেছিল না, ওসব মেয়ে হলে সহ্য করতে হয়। মেয়ে জন্ম পাপের জন্ম। বলেনি বাবা?
বলাই তাকে সব সুখ দিয়েছিল। দিয়েছিল তো, ভরপেট খেতে পেত না সত্যিই প্রথম প্রথম, কিন্তু কি সুখ ছিল জীবনে। একবার তারা মিথ্যা বলে একটা বিয়েবাড়ি খেতে ঢুকে গিয়েছিল, ভাগ্যে ধরা পড়েনি!
হীরুর চোখের কোন বেয়ে একবিন্দু জল পড়ল গাল গড়িয়ে। বুকু দেখল। কিন্তু বুঝল না। মায়ের ঠোঁটের কোণায় হাসিও দেখল যেন মনে হল। মায়ের কি মাথাটা...
বুকু, বাপ্পা কেমন ছেলে রে?
বুকু চুপ করে রইল।
বল যা জিজ্ঞাসা করছি।
ভালো।
নেশা করে?
মাঝে মাঝে
কাজ কি করে?
রিচার্জের দোকান, ওর আর ওর দাদার।
তুই আগে থেকে জানতিস?
বুকু চুপ।
বাপ্পা নিজেই বলেছিল?
না
বুচি?!
বুকু চুপ।
তুই কি বলেছিলি? আমায় জানাসনি কেন?
বুকুর চোখ ছলছল।
তাদের প্রথম সন্তান যখন হল, বলাই প্রতিজ্ঞা করেছিল, আর মদ ছোঁবে না। ছোঁয়নি আর। সত্যিই সে সুখী ছিল। মারা যাওয়ার আগে বলেছিল, ছেলেমেয়েগুলো যেন মানুষ হয় তুমি দেখো... অমানুষ হওয়া কাকে বলে?
বুকু, টোটোটাকে গঙ্গার ধারে যেতে বল, আজ মঙ্গলবার, চল সিদ্ধেশ্বরীঘাটে অনেকদিন যাইনি, মায়ের পূজোও দেওয়া হবে ওদের নামে।
বুকু বড়বড় চোখ করে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। বলল, বাপ্পা খুব ভালো ছেলে মা, ও আমার ভয়েই বোধ হয়... তুমি দেখো আমি আজ রাতের মধ্যেই ও শালার খোঁজ আনব... বুকুর ঠোঁট কেঁপে গেল। মুখ ঘুরিয়ে নিল...
হীরু মনে মনে বলল, তোমার ছেলেমেয়ে অমানুষ হবে না, দেখো...