ছ'টা বেজে গেছে। শ্যামনগরের জগোদ্ধারণ ক্লাবের অনুষ্ঠান আজ। রবীন্দ্রসন্ধ্যা। মে মাসের দশ তারিখ। কিছুক্ষণ আগে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। প্যাচপেচে গরম। ক্লাবের সেক্রেটারি পানুহরিবাবুর সিল্কের পাঞ্জাবী ভিজে চপচপ। বয়েস ষাট ছুঁইছুঁই। গত উনিশ বছর ধরে উনিই সেক্রেটারি আছেন।
লোকজন জমায়েত ভালোই হয়েছে। এই বিষয়ে অবিশ্যি এই ক্লাবের যথেষ্ট সুনাম। প্রচুর লোক হয় যে কোনো অনুষ্ঠানেই। শিল্পীদের সংখ্যা প্রতিবারই দর্শকদের তুলনায় ঈর্ষনীয় পরিমাণ বেশি হয়। এবারেও তাই। কচিকাঁচা, মধ্য, বয়স্ক ইত্যাদি সবার সমাগমে একেবারে সরগম চারদিক। অনুষ্ঠান শুরু হল। উদ্বোধনী সংগীত গাইলেন সেক্রেটারী পানুহরিবাবুর শালী বেলাকুসুমকলি দিদিমণি। উনি পাড়ায় বুটিক শেখান। প্রথম গান 'পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহ ভাই' তারপর সব্বার অনুরোধে 'মধুমালতী ডাকে আয়'। নেমেই পড়ছিলেন, এমন সময় পানুহরিবাবুর মুখের দিকে চোখ পড়ল। উনি দুষ্টু হেসে বললেন, সেই গানটা গাইবে না কলি? অমনি কলিদিদিমণি গাইলেন, 'তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার।'
পানুহরিবাবুর চোখে জল চলে এল। এই গানটা প্রত্যেক রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ওনার শোনা চাই। আর প্রত্যেকবারই ওনার এমন বেসামাল অবস্থা হয়। সত্যিই - দিল তো বাচ্চা হ্যায়। পানুহরিবাবু আড়ালে গিয়ে চোখ মুছে আসলেন।
ইতিমধ্যে বাচ্চাদের তিনটে নাচ হয়ে গেছে, 'হও ধরমেতে ধীর', 'সঙ্কোচেরও বিহ্বলতা' আর 'এই মনের রেডিও'।
তারপর স্টেজে উঠবেন সেক্রেটারিবাবুর স্ত্রী ননীচোরাদাসীবালা দেবী। ওদের দুই বোনের নামই ওদের পিসিমা ঠিক করে রেখে তবে নিশ্চিন্তে স্বর্গে গিয়েছিলেন। তাই একটু এমনধারা নাম। যাহোক পল্টু ঘোষণা করল, আজ এই রবীন্দ্রসন্ধ্যা আপনাদের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে সার্থক হয়ে উঠেছে। আসুন এবার আমাদের সেক্রেটারি বৌদির কণ্ঠে, আজ এই পবিত্র রবীন্দ্রসন্ধ্যায় আমরা শুনব কয়েকটা নজরুলগীতি। হাততালিতে চারদিকে ফেটে পড়ল। উনি এখানকার মহিলা উন্নয়ন কমিটির প্রধান। এমন কোনো বাড়িই প্রায় নেই যে বাড়িতে ওনার উপস্থিতিতে কোনো সমস্যা আরো জটিল না হয়েছে। উনি পুরুষজাতটার উপর একটু বেশিই প্রসন্ন বলেই নাকি লোকে বলে এই পদটাতে টিকে গেছেন।
যাহোক তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য নজরুলগীতিগুলোর মধ্যে হল, 'গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি', 'মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা' আর 'মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য'।
এবার ভাষণের পালা। সেক্রেটারি পানুহরিবাবুর অত্যন্ত আবগেপ্রবণ আর উত্তেজিত লাগে এই সময়টায়। বহুবার কেঁদে ফেলেছেন স্টেজে। এই তো গেলবার, স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলনের ভাষণে। বাচ্চাদের মত কেঁদে ফেলেছিলেন সেই ঐতিহাসিক মুহুর্তটার কথা স্মরণ করে। গান্ধীজির বাড়িতে কি একটা সমস্যা, ও হ্যাঁ কস্তুরবা সন্তানসম্ভবা ছিলেন। গান্ধীজি নেতাজিকে ফোনে একটা ডাক্তার ডাকতে বলেন। নেতাজী বিধান রায়কে নিয়ে আসছেন, এমন সময় উইস্টন চার্চিল রাস্তা আটকে, সে কি হেনস্থা, সে কি হেনস্থা নেতাজীকে! ওদিকে কস্তুরবা'র প্রসব যন্ত্রণা, মহাত্মা ঘরবার ঘরবার করছেন.... উফ্, আর পারলেন না পানুহরিবাবু। ভেঙে পড়লেন। জুনিয়ার সেক্রেটারি লালটুবাবু তাড়াতাড়ি পাড়ার একটা ছেলেকে দিয়ে গ্লুকোজ আনতে পাঠান। কারণ পানুবাবুর হাইসুগার। কেঁদে সুগার ফল করলে?
আরেকটা ঘটনাও মনে আসল, বিজয়া সম্মিলনী চলছে। আবার ভাষণের পালা। পানুহরিবাবু বলতে উঠলেন। কে এই দূর্গা? এই বিষয়ে বলবেন। শুরু করলেন, কি ভাবে নিউটন, আইনস্টাইন, গ্যালিলিও, সবাই মিলে জগদীশবাবুর গীতা, বেদান্তখানা হাতিয়ে একটার পর একটা বৈজ্ঞানিক তথ্য, যা নাকি সব ওই বইগুলোতে সূত্রাকারে লেখা ছিল, সেগুলো সব টুকে টুকে একটা একটা করে বৈজ্ঞানিক তথ্য আবিষ্কার করেন। ওনার নাম নোবেলেও যায়। সাথে ব্যাসদেবেরও। কিন্তু ওই নচ্ছার ফিরিঙ্গি বিজ্ঞানীগুলো সব গুবলেট করে দেয়। নেতাজী ফাইলের বাকি পাতাগুলো খুললেই সব তথ্য হুড়হুড় করে প্রকাশ্যে চলে আসবে বলে পানুহরিবাবু বিশ্বাস করেন।
তারপর লোকনাথবাবাকে স্মরণ করতে করতে কিভাবে জগদীশবাবু বাড়ি ফেরেন। বলতে বলতে এত উত্তেজিত হয়ে পড়েন পানুহরিবাবু যে প্রেশার বেড়ে স্টেজে ফিট হয়ে যান। তারপর তিনদিন নার্সিংহোমে থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন।
তো পানুহরিবাবু স্টেজে উঠলেন। রবীন্দ্রনাথ ও সাহিত্য সম্বন্ধে বলবেন। শুরুতেই ওনার গলা কেঁপে গেল। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে ওদের একটা পারিবারিক দুর্বলতা আছে। ওনার ঠাকুরদা নাকি বাইশে শ্রাবণ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। পরিবারের লোকেরা বলে রবীন্দ্রবিরহে। নিন্দুকেরা বলে, অতিরিক্ত কাঁঠাল খেয়ে।
সে যাক, পানুহরিবাবুর বাবা, রবীন্দ্রনাথকে নকুলদানা না দিয়ে জলস্পর্শ করতেন না। এমনকি পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ উপোস থাকতেন। বছরে একবার করে শান্তিনিকেতনে থেকে একাদশী পালন করতেন সপরিবারে।
এবার প্রসঙ্গে আসি। পানুবাবু নিজেকে সামলে শুরু করলেন, উপস্থিত রবীন্দ্রগুণমুগ্ধ সাথী ও সঙ্গিনীরা। রবীন্দ্রনাথের কথা কি বলব। তবে আজ একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য আপনাদের দেব। যা কয়েকদিন আগেই নেটে পড়লাম। ওদেশের খবরের কাগজেও অবশ্য বেরিয়েছে। এমনকি ওদের পার্লামেন্টও নাকি একদিন বন্ধ ছিল এত গোলমাল হয়েছিল সেই খবরটা নিয়ে। আমার শ্যালিকার বড় দেওরের খুড়শ্বশুরের শালা ওই দেশের কমিশনার কিনা, সেই বললে।
সভায় সবাই নড়েচড়ে বসল। কি খবর!
পানুবাবু বললেন, রবীন্দ্রনাথের কপালকুণ্ডলা কে না পড়েছেন! শুনলে হতবুদ্ধি হবেন, সেটিও নাকি নোবেলের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু হলে হবে কি? ওই বাধ সাধল ওদের দেশের হিংসুটে কবির দল। বায়রণ, শেলি, কিটস এরা সব মিলিত আবেদন করে সে পুরস্কার রদ করলেন।
হরেনবাবু এ পাড়ায় নতুন। উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কিন্তু ওটা যে বঙ্কিমের লেখা মশায়!
অমনি পাড়ার লোকেরা হইচই করে উঠল। একজন বললেন, সেই তো পুরোনো সরকারের মান্ধাতা আমলের সিলেবাস পড়ে বড় হয়েছেন, নেট টেট ঘাঁটেন? অর্বাচীন কোথাকার!
পানুবাবু অবিশ্যি নিরুত্তাপচিত্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সবই চক্রান্ত মা! সবই চক্রান্ত! যা হোক আজ বিকালে নাটকে আপনাদের উপস্থিতি কামনা করি। প্রখ্যাত লেখক গঞ্জন বন্দোপাধ্যায়ের লেখা, 'বৌ বনাম বৌদি'।
(ছবিঃ সুমন)