Skip to main content

সানাই তাকে পেয়ে হারিয়ে কাঁদে? না, তাকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় কাঁদে?

     এ দ্বন্দ্ব আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি মনোরমা। যখনই সানাই বেজেছে, বুকে কান্না উঠেছে। কিন্তু কেন? কাকে সে চায়? সে মুখটা স্পষ্ট নয়। বিয়াল্লিশ বছর আগে যখন পুরোহিত মন্ত্র পড়ছিল, চারদিক হুল্লোড়, সানাই বাজছিল মনোরমাকে কাঁদিয়ে একা একা, গোপনে। মনোরমা নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছে, কে সে? কার জন্য এমন বুক হাহাকার কান্না তার?

      মন উত্তর দেয়নি স্পষ্ট করে। শুধু বলেছে, এ সে নয়, যার হাতের উপর হাত, এ নয় সে।

     মনোরমা মনকে সরিয়ে সংসারে ঢুকেছে। কর্তব্য করতে করতে কবে মন শরীরের সঙ্গে এসে পাশে জুড়ে বসেছে, খেয়াল করেনি। সুখের লোভ। সে লোভ ছাপিয়ে যাওয়ার মত আরো বড় লোভ সংসারে কোনোদিন তাকে টানেনি বলেই ঈশ্বরের কথা আলাদা করে ভাবেনি কোনোদিন সে। সংসার করতে গিয়ে উৎসবে, পার্বণে যতটা ঈশ্বরের জায়গা, ততটাই দিয়েছে। যত্ন করেই দিয়েছে।

     আজ এত অচেনা মানুষের মধ্যে একা বসে থাকতে থাকতে অনেক পুরোনো দিনের অনুভব জেগে উঠছে। একটু দূরে বিয়েবাড়িতে সানাই বাজছে। মারু বেহাগ। মনোরমা আজ চেক আপে এসেছে। ছানি কাটানো হল কদিন আগে। একাই এসেছে। কারণ সঙ্গে কেউ আসার নেই।

     মনোরমার একা লাগার অনুভবটা নতুন না। বাস্তবের সব কিছুর সঙ্গেই যেন তার একটা আলগা সম্পর্ক। এক ছেলে, বাইরে চলে গেল। মনোরমার মনে হয়েছিল হয় তো ভীষণ ফাঁকা লাগবে। লাগেনি। ঋষভকে ছেড়েও তার মধ্যে এক আলাদা মনোরমা বাকি থেকেই গেছে, সে কারোর সঙ্গেই কোনো সম্পর্ক রাখে না। এমনকি এতগুলো বছর একসঙ্গে কাটিয়ে আসা তার সিঁদুরের মানুষ অমিতের জন্যেও না। অমিত বিছানায় শয্যাশায়ী চার বছর হল।

     মনোরমার নিজেকে স্বার্থপর লাগে এক এক সময়। স্বার্থপর না উদাসীন? বুঝতে পারে না।

     "আপনাকে ডাকছে।"

     মনোরমা তাকালো। চশমার দোকানের ছেলেটা। তার নাম্বার এসে গেছে মানে। মনোরমা কানে শোনে না। নাকি শুনতে চায় না?

     চেম্বারের বাইরে এসে দেখে বৃষ্টি নেমেছে ভীষণ। কখন মেঘ করল এত? অবশ্য বেরিয়েইছে তো সন্ধ্যেবেলা, কে আকাশের দিকে তাকায়? টোটোওয়ালাটা কোথায়? নেই।

     মনোরমা আবার দোকানের বেঞ্চে বসল। এখনও অনেকে পেশেন্ট। তার মত দু একজনই আছে যারা একাই এসেছে। কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছে না। বৃষ্টির দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বসে অনেকেই। মানুষ কত অল্প পরিবর্তনেই বিরক্ত হয়। মনোরমারও শরীরটা যখন অবাধ্য হতে শুরু করল ধীরে ধীরে, যখন মনে হতে লাগল সত্যিই শরীরটা আসলে শুধুই যন্ত্র একটা, মনোরমার বিরক্ত লাগত। মন আর শরীরের এমন অসহ্য দৌরাত্ম্য সহ্য করা ছাড়া জীবন আর কি? মনোরমা নিজে আসলে কে? কাকে চায় সে? কে সে? আদৌ কি কেউ আছে, বা ছিল তার জন্যে, একান্ত তার জন্য? নাকি মানুষের মনের মধ্যে আদিকাল থেকেই একজন এস্কেপিস্ট থাকে যে সব সময় বাস্তবকে তুচ্ছ করে নিজেকে বড় করতে চায়। আর তাই ঈশ্বর, নীতি, আদর্শ - এইসব মোড়কে নিজেকে ঢেকে রাখে?

     সানাইয়ের সুর বদলে মিঞা মল্লার করে দিল কেউ। মানে কেউ আছে বিয়ে বাড়িতে যে সুর বোঝে। বিয়ে বাড়ির সামনে গাড়িগুলো ভিজছে, কুকুরদের ভিড় ডাস্টবিনের পাশে। কয়েকজন ভিখারিও বসে রাস্তার উল্টোদিকে।

     মনোরমা চারদিক ভালো করে তাকালো, টোটোওয়ালার পাত্তা নেই। পেশেন্ট কমে এসেছে। এবার লজ্জা লাগছে। সবাই জেনে যাবে তার অসহায়তার কথা। কেউ টোটো ডেকে দিতে চাইবে। কেউ গাড়িতে পৌঁছিয়ে দিতে চাইবে। ডাক্তার বেরিয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারে, আপনি এখনও যাননি? এই লাংসের অবস্থা আপনার? ছিছি... যান….

     হয় তো এগুলো কিছুই ঘটবে না। তবু মনোরমার কান মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।

     হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল মনোরমা। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রাস্তায় নেমে গেল। নেমেই পাশের একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। এখনও মিঞা মল্লার বাজছে। বৃষ্টিতে স্নান করে যাচ্ছে মনোরমা। সানাইয়ের কান্নাটা এখনও কাঁদাচ্ছে। তার লাংসের অবস্থা ভালো না। কেমো চলছে। সে বাঁচবে না বেশিদিন। হঠাৎ তার মনে হল সানাইয়ের কান্নাটার মানে সে বুঝে গেছে। মনোরমা কাউকে চায় না সংসারে, কাউকে না, ঈশ্বর, প্রেমিক, সমাজ কাউকে না, সে শুধু নিজেকে চায়। মানুষ হাজার ভাগে নিজেকে দিতে দিতে বুঝতে পারে হয় তো তার নিজের কাছে নিজের জন্যেই আর অবশিষ্ট থাকবে না কিছু। মানুষ সব চাইতে বেশি একান্তভাবে নিজেকে চায়। মনোরমাও নিজেকে চাইছে। নিজেকে ভীষণ ভীষণ আদর করতে, ভালোবাসতে ইচ্ছা করছে। এই তো সে, রাস্তায় একা হাঁটছে। কানে সুর মিলিয়েছে অনেকক্ষণ, এখন সে সুর প্রাণে বাজছে। নিজেকে খুঁড়ে নিজেকে দু হাতে উদ্ধার করে আনছে মনোরমা সানাইয়ের সুর চিনে চিনে। যেন ভূমিকম্পে ধ্বসে যাওয়া বাড়ির ভিতর থেকে উদ্ধারকারী দল একটা শিশুকে বার করে আনছে সযত্নে। এতদিনের অভ্যাসের, বিশ্বাসের আড়ালে চাপা পড়ে থাকা তার একান্ত যে আমি, যেটুকু নিয়েই সে সত্যিকারের জন্মেছে এই সংসারে, সেই আমিটুকুকে সে দুহাতে করে উদ্ধার করে কোলে নিচ্ছে। চুমু খাচ্ছে। দু চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। ডাস্টবিনের পাশে বসে থাকা সব ভিখারি, কুকুরের দল যেন বর্ষায় ভেসে যাচ্ছে কোথায়। সব হারিয়ে যাচ্ছে। সে আর বসবে না কারোর ডাস্টবিনের পাশে। একাই বাঁচবে। রাস্তা দেখাবে সানাই।