Skip to main content


"তুমি কতদূরে গেছো?"
প্রজাপতিটা জিজ্ঞাসা করল রেললাইনকে। রেললাইনটার এ মাথা ও মাথা দেখা যায় না। এক জঙ্গলের থেকে বেরিয়ে সে আরেক জঙ্গলে গেছে মিশে। প্রজাপতি তার সাধ্যমত কতদূর উড়ে দেখে এসেছে তো। কিচ্ছু দেখা যায় না, কোথায় ওর শুরু, কোথায়ই বা ওর শেষ।
লাইন বলল, সেই সমুদ্রের পাড়ে আমার শুরু, শেষ হল গিয়ে সেই হিমালয়ে। কত মরুভূমি, নদী, শহর, গ্রাম, মাঠ পেরিয়ে আমার পথ। তুমি তার হদিস পাবে কি করে? এই তো তোমার ছোট্ট শরীর!
প্রজাপতির ডানা উঠল কেঁপে। সে বলল, নাই বা পেলুম। এই যে অর্জুন গাছটির তলায় ছায়াঘেরা তুমি, এইটে আমার। তুমি এইখানেই আমার সাথে কথা বোলো, কেমন?
লাইন বলল, আচ্ছা।
লাইন বলে সংসারের কথা। মানুষের আসার কথা, ছেড়ে যাওয়ার কথা। গ্রামের কথা, শহরের কথা, নদীর কথা। রাতের কথা, দিনের কথা।
প্রজাপতি বলে ফুলের কথা, মধুর কথা, রঙের কথা, মাকড়সার কথা, জালের কথা।
কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা ওরা বলেই চলে। শেষ আর হয় না। যখন কোনো ট্রেন এসে পড়ে প্রজাপতি গিয়ে বসে পাশের গাছের ডালে। লাইনের কেঁপে কেঁপে ওঠা বুকের সাথে সাথে তারও বুকে লাগে দোলা। তার নেশা ধরে। মনে হয় কি শক্ত পেশীতে সে পার করে দিচ্ছে সেই বিশাল যানটাকে একাই। প্রজাপতির গর্বে বুক ফুলে ওঠে।
প্রজাপতি মাঝে মাঝেই ফুলের রেণু নিয়ে আসে লাইনের জন্য। তার সারা গায়ে মাখায়। বলে, দেখো কেমন রঙ, কেমন গন্ধ!
লাইন হাসে আর বলে, বোকা!
যাচ্ছিল তো এমন করে দিন। একদিন প্রজাপতি এসে বলল, জানো আমার ডানায় ভারী ব্যাথা। উড়তে কষ্ট পাই। তারপরের দিন এসে বলল, জানো আমার বুকের ভিতর বড় ব্যাথা। শ্বাস নিতে বড় লাগে। লাইনের খুব কষ্ট হয়। সে কিছু করতে পারে না। শুধু চেয়ে থাকে আর বলে, ঠিক হয়ে যাবে, দেখো।
তিনদিন হল, প্রজাপতি আর আসে না। লাইন একে তাকে জিজ্ঞাসা করে। কেউ জানে না। কেউ চিনতেও পারে না, বলতেও পারে না।
চতুর্থদিন এলো প্রজাপতি। শীর্ণ দেহ। ক্ষীণ কন্ঠস্বর। কেউ কোনো কথা বলল না। ছুঁয়ে থাকল শুধু সমস্ত শক্তিটুকু দিয়ে নিজেদের।
সন্ধ্যের খানিক আগেই প্রজাপতি পড়ল ঢলে। তার প্রাণ শরীর ছেড়ে অর্জুনগাছের কোল ঘেঁষে গেল উড়ে। লাইন বুক চেপে থাকল শুয়ে। সব ট্রেন পার করল। আজ তার বুক কাঁপল দ্বিগুণ জোরে। ফোঁপানো কান্নার মত।
ভোর হল। পিঁপড়ের সারি এল মৃত প্রজাপতির দেহটাকে নিয়ে যেতে। লাইন বলল, না! না না না!
শুনল না। একটা মালগাড়ি এল ছুটে। তার বুকের পাঁজর প্রবল বেগে চেপে গেল ধেয়ে। মালগাড়ি যখন গেল, তখন আর কিছু নেই বাকি।
গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহে রেলের বুকের তাপ উঠল জ্বলে। কিছু মেলালো কালের নিয়মে, কিছু থেকে গেল গভীর দাগ নিয়ে।

সেদিন বর্ষার প্রথম মেঘ আকাশে। লাইনের বুকটা প্রজাপতির জন্য করল হুহু করে। এমন সময় তার গায়ে লাগল কিসের স্পর্শ - শুঁয়োপোকা! কি বিশ্রী তার দেহ, তবু কেন যেন কি পরিচিতের মত সুখ ওর সারা গায়ে। পরিচয় হল।
দিন গেল। ওই অর্জুনগাছের নীচের লাইনটায় এখন ঝাঁক ঝাঁক প্রজাপতির দল। কান পাতো, পাবে গুনগুন স্বর। কার? লাইনের না, ওই প্রজাপতির দলের না। এসো, অর্জুন গাছটার দিকে চাও। দেখো কোন এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বরের এ আওয়াজ। কি মধুর, কি করুণ!