আজকে তোমাকে ব্যর্থ প্রতিপন্ন করার দিন। যে তোমার সারাটা জীবন গেল সংসার সামলাতে সামলাতে। ছেলেমেয়ে মানুষ করতে। আজকে তুমি যদি খবরের কাগজ পড়ো, দেখবে তুমি ভীষণভাবে ব্যর্থ। কারণ তুমি তোমার যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারোনি। তুমি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নও। তুমি একটা জীবনে স্বামী নির্ভর। পরের জীবনে সন্তানের উপার্জনের উপর নির্ভর। তোমার কোনো উচ্চাকাঙ্খা নেই। তোমার স্বাধীনতা নেই। তুমি ব্যর্থ।
অথচ আমার সমস্যা হল আমি তোমাকেও দেখেছি। ট্রেনে, বাসে, রাস্তায়ঘাটে। পরিবারের সঙ্গে। একাও। কোনো অফিস-কাছারি-ব্যবসা ইত্যাদিতে যাচ্ছ না। যেখানে গেলে আলোচনা হয়, গৌরবের ছটা এসে পড়ে মুখেচোখে। তুমি হয় তো বাজারে যাচ্ছ, তুমি হয় তো কোনো অসুস্থ আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবকে দেখতে যাচ্ছ, কিম্বা পুজো দিতে যাচ্ছ। আমি তোমাকে দেখেছি। অনেকবার দেখেছি। বেশি বেশি দেখেছি। ব্যর্থ তোমাদের দেখেছি।
তোমরা ভীষণভাবে ব্যর্থ। কারণ তোমাদের নিয়ে আলোচনা করা যায় না। তোমাদের নিয়ে আলোচনা তখনই হতে পারে যদি তোমরা স্বামী-পুত্র-শাশুড়ি-শ্বশুর-দেওর ইত্যাদি দ্বারা অত্যাচারিত হও। তোমরা যদি পরকীয়ায় জড়াও। তোমরা যদি আত্মহত্যা করো। তখন তোমরা মানুষের আলোচনার ভাষায় স্থান পাও। নইলে তো তোমারা নেই। মাটির মত নেই। আকাশের মত নেই। যতক্ষণ না মাটিতে জন্মায় ঢিবি, হোঁচট খেয়ে পড়ি। যতক্ষণ না আকাশ ঘিরে আসে কালবৈশাখীর মেঘ, বৃষ্টিতে ভিজে মরি, কী বাজের ভয়ে মরি।
তোমাদের ওই সঙ্কীর্ণ গলিখুঁজি জীবনে যে কোনো স্বাভাবিক সুখ আছে, মর্যাদা আছে আজকের দিনে আমাদের বিশ্বাস হয় না। পরিবারের মর্যাদা শুধু অর্থ উপার্জনে, অথবা তার বিনিময়ে গায়েগতরে খেটে পুষিয়ে দিয়ে। আরো খারাপ কথাও শুনেছি। আদিরসের ইঙ্গিতপূর্ণ। থাক। বলতে ইচ্ছা করল না। কারণ তার মধ্যে আমার মা, ঠাকুমা শুধু না, আমার এত এত আত্মীয় পড়বেন যাদের কোলেপিঠে আমি মানুষ হইছি। যাদের স্নেহতে এই পৃথিবীর আলো, মাটি, বাতাস, ঈশ্বর মধুময় হয়েছে। যাদের হাত ধরে এই এত বড় বিশ্বের মুখোমুখি হয়েছি। যাদের সুখ, আত্মমর্যাদার বোধ, আনন্দের আঁচল আমাকে এতদিন অবধি মানুষের উপর বিশ্বাস রাখতে শিখিয়েছে। সেকি কয়েকজন মৃত মহান মানুষদের বাণী পড়ে হয়েছে গো? একদম না। আমি ঘরে বাইরে যে শক্তির জোরে হেঁটেছি সে তাদের দেওয়া শিক্ষার জোরে। হীনমন্যতায় ভোগা মানুষের কি কাউকে আলোর রাস্তা দেখানোর ক্ষমতা থাকে? না তো।
কিন্তু এ সব কথা বলার নয় আজ। আজ পরিবারের কথা বলতে নেই। আজ পরিবারকে গৌণ করে নিজেকে মুখ্য ভাবার দিন। তবেই তুমি সার্থক। আসলে আমি স্কিম অতটা বুঝি না। আমি বাস্তব বুঝি। এত এত সহস্র সহস্র তোমরা, যারা পরিবার নিয়ে সুখে আছ, আত্মমর্যাদায় বেঁচে আছ তাদের যখন উপেক্ষা করে একটা কর্পোরেটমার্কা কৃত্রিম উৎসবের হইহই হয়, আমার মনে হয় কোথাও একটা বড় মিথ্যা কিছু হচ্ছে। একটা বড় অংশের মানুষকে একদম এক রেখার টানে উপেক্ষা করা হচ্ছে। গৌরবহীন করে দেখা হচ্ছে। একপেশে গল্পের মোড়কে পুরে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেখানো হচ্ছে।
সব সমাজের একটা নিজস্ব ধারা আছে। সে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। কিন্তু তাকে ধরেবেঁধে অন্য একটা সমাজের রীতিনীতির মত করে গড়ে তুললেই কি তার আধুনিকিকরণ হয়? নিজস্বতা হারিয়ে অন্যকে অন্ধের মত অনুকরণই কি আসলে উন্নতির রাস্তা?
আরো ভয়ংকর কথা বলি। আরো ভয়ংকর। আমি তো তোমাকেও দেখেছি যে কোনোদিন বাইরে কাজে আসতে চাওনি। কি ভয়ংকর না? কি ভীষণ পিছিয়ে যাওয়া, ধিক্কার জানানো মানসিকতা না? ছি!! হ্যাঁ আমিও ওদের সঙ্গে একটা “ছি” লিখে দিলাম।
লিখব নাই বা কেন? সারাটা বিশ্ব যখন মেয়েদের স্বনির্ভর হতে শেখাচ্ছে, কে না চায় অর্থনৈতিক স্বনির্ভর না হতে? এ তো শুধু নারীত্বের অপমান না, মনুষ্যত্বেরও অপমান।
কিন্তু তবু দেখেছি তোমাকে, যে “বাধ্য” হয়ে কাজ করতে বেরিয়েছ। যার মন লাগে না পরিবারের বাইরে। যে শুধু উপায় খোঁজে আবার কী করে আগের জীবনে ফিরে যাওয়া যায়। আমি তোমাকেও দেখেছি। বর্তমানের ট্রেণ্ডের হাওয়া গায়ে না লাগা তোমাকেও দেখেছি। অজস্রবার দেখেছি।
আসলে কী জানো, স্বাধীন চিন্তা একটা শব্দ। বাস্তব না। আমাদের স্বাধীন চিন্তা মানে বৈষয়িক লাভের চিন্তা। গ্ল্যামারের চিন্তা। ট্রেণ্ডে গা ভাসানো চিন্তা। মানুষের ইচ্ছার মর্যাদাই যে স্বাধীন চিন্তার ভূমিতল, সেটা ভুলে যাই। তোমার ইচ্ছা যদি আমার ইচ্ছার অনুকূল না হয়, তবে তুমি ব্যর্থ। আবার আমার চিন্তা যদি ভীষণভাবে সেলিব্রেটেড হয়, তবে তো তোমার অবস্থা আরো করুণ। কারণ সেলিব্রেশান ঠিক করে যে মার্কেটিং এর মানদণ্ড, সেখানে ইচ্ছার মর্যাদার চাইতে স্ট্যাটেসটিকস’এর কদর বেশি, হাততালির কদর বেশি, সেখানে আলোড়ন তুলতে না পারলে তুমি ঘিনঘিনে এক ঘেঁয়ে। আলোড়ন তোলাই সেখানে জীবনের সেলিব্রেশানে একটা দিক।
আজ শিবরাত্রি। তোমাদের মত ব্যর্থ প্রাণেরা স্বামীপুত্রর জন্য না খেয়ে উপোস করো। ছি ছি। শিবলিঙ্গে জল/দুধ ঢালো। (যে দুধ ঢালা আরেকটা আলোড়ন জাগানো বিতর্কের বিষয়, এখানে সে আলোচনা নয়।) তোমাদের দেখে আমরা লজ্জা পাই। তোমাদের উপর আমাদের উপেক্ষার পর্দা ঢাকি। আমরা সেই সব প্রজন্মের মানুষ যেখানে আমরা প্রতি মুহুর্তে নিজস্বতায় বাঁচি। পরিবার আমাদেরও আছে। আমাদেরও শখ আহ্লাদ আছে। আমাদেরও স্বামী-সন্তান নিয়ে সময় কাটানোর ইচ্ছা হয়। তবে তার জন্যে তোমাদের মত গোটা জীবনটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে বসি না। দাসত্ব করি না কারো। তোমার ও মর্যাদা, তোমার ও সুখ সব পুরুষতন্ত্রের উচ্ছিষ্ট। তুমি তাতেই সুখী, দেখে আমার ঘেন্না হয়। আমাদের এই প্রজন্মকে তোমরা বুঝবে না। আমাদের দেখে তোমাদের নিশ্চয়ই দীর্ঘশ্বাস পড়ে, ঈর্ষায় বুক জ্বলে যায়, নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের এই মা-ঠাকুমা-দিদিমার প্রথাগত জীবন বাঁচতে বাঁচতে, “প্লেইন হাউজওয়াইফ” পরিচয়ে বাঁচতে বাঁচতে, বাড়ির হাজার গঞ্জনা-লাঞ্ছনা সহ্য করতে করতে আত্মগ্লানির শেষ ধাপে বেঁচে আছ? অন্তত আমি তো জানি এ সত্যি। আমি জানি কোনো ক্রাইসিসে কী ভাবে তোমরা ভিখারির মত স্বামী-সন্তানের কাছে হাত পাত। ছি! আজকের দিনটা অন্তত আমাদের লজ্জা দিও না প্লিজ। আজকের দিনটা অন্তত নিজেকে আড়ালে রাখো। কাল থেকে এ নিয়ে আর আলোচনা হবে না। কে শুধু পরিবারের পাঁকে বসে ব্যর্থ জীবন বাঁচে আর কে সাফল্যের মিনারে বসে আলোকিত জীবন বাঁচে সে নিয়ে আলোচনা হবে না।
চারপাশের এই গ্ল্যামারহীন, খবরের কাগজে ছাপার যোগ্য জীবনযুদ্ধহীন, সাধারণ, অতিসাধারণ জীবনগুলোর নিত্য জীবনের যে ছোটো-ছোটো লড়াই, ছোটো-ছোটো লাভ-ক্ষতি, জন্ম-মৃত্যু, উৎসব-বিষাদে ঘেরা জীবন, সবকে অর্থহীন বলি, এতবড় অর্থ জীবনে খুঁজে পেয়েছি? আমি তো পাইনি। সত্যকে সব সময়েই দুই চূড়ান্তের মধ্যখানে ক্ষীণ স্রোতের মধ্যে বয়ে যেতে দেখেছি। আমার প্রণাম সেখানেই গিয়ে মিশেছে। কারণ আমি নিজেকে প্রণম্য ভাবি না। সফল ভাবি না। আবার ব্যর্থ, “লুজারও” ভাবি না। আমি আছি সময়ের এক খণ্ডে, যেখানে ভাগ্য আর বাস্তবের সঙ্গে নিজের বোধের তালমিল খুঁজে চলেছি। এ কি এতটাই হেয়?