খবরটা রটতেই রাত দুটো থেকে লোক জমা হতে শুরু করল। কনকনে ঠাণ্ডায় বারুইদের উঠানে এক এক করে লোক জমছে। পেয়ারা গাছে বসে থাকা প্যাঁচাটা ডাকছে না। লোক দেখছে। এত রাতে এত লোক! আধখানা খাওয়া চাঁদটাও যেন থমকে দাঁড়িয়ে, এত মানুষ!
বারুইদের বাড়ির বুড়োটা মরেছে। সুশীলের
জ্যাঠা মরেছে। নবর ঠাকুর্দা মরেছে। সুজনের কাকা মরেছে।
মারা গেছে একজনই, কার্তিক বারুই। বউ
মরেছে বছর দশেক আগে। নিঃসন্তান কার্তিক শেষ আট বছর ছিল ভাইয়েদের কাছে। ভাইয়েদের ভরা
সংসার।
হাঁপানির টানে সারারাত জেগে বসে থাকত
কার্তিক। মাথাটা মাটিতে ঠেকিয়ে, পিছনটা উঁচু করে এই উঠানে বসে থাকত সারা সন্ধ্যে। টান
উঠত। যেন হাপর বসিয়ে দিয়ে গেছে কেউ বুকে। বুকটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ওঠাপড়া করত। প্রাণটা
গলার কাছে এসে আটকে থাকত। বেরিয়েও বেরোতো না। আজ রাতে বেরিয়ে গেল হঠাৎ করে। বৌদি এঁটো
থালা তুলতে এসে দেখে, চোখ খোলা ছাদের দিকে, পড়ে আছে, বালিশের একদিকে হেলে আছে মাথা।
হিসি, হাগুতে মাখা কাপড়চোপড়।
উঠান ভরে গেছে লোকে। এখন রাস্তায় লোক
জমছে। কম্বল, চাদর মুড়ি দেওয়া মানুষ গম্বুজের মত স্থির এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে। কেউ কারোর
সঙ্গে কথা বলছে না। সবাই বিরক্ত। সবাই অস্থির। কারোর কম্বলের ভিতর থেকে বাচ্চার কান্নার
আওয়াজ ভেসে এলো। প্যাঁচাটা উড়ে গেল। শ্মশানযাত্রী হলে খেতে দিতে হয় কিছু। সবাই জানে।
কিন্তু এত মানুষ, বারুইদের মনে থাকবে? কেউ বাদ যাবে না তো!
কার্তিক কাঁধে চড়ে বেরোলো। একশো তেরোজন
শ্মশানযাত্রী। রাত পৌনে তিনটে। সবাই কম্বলের ঢাকা খুলে মুখ বার করল। "বলো হরি,
হরিবোল…. বলো হরি, হরিবোল…." সবার গলার চীৎকার। উপস্থিত ধ্বনি। বারুইদের চেনাতে
হবে। বারুইদের দুই ভাই কলকাতায় কাজে যায়। এ গ্রামে কাজ নেই বাড়ি বাড়ি। বসা সব। কেরল,
মহারাষ্ট্র, গুজরাট সব ঘরের মধ্যে এখন। কেউ ডাকে না। বাচ্চাকাচ্চা ঘিরে ঘরময়। বিরক্তি।
রাগ। খিদে। ক্ষোভ। কতজন ইচ্ছা করে শরীরটা ছেড়ে গেল। গাছে ঝুলে। বিষ খেয়ে। বাচ্চাগুলোর
স্কুল বন্ধ। বন্ধ স্কুলের দুপুরের খাওয়া। পড়াশোনা নেই। সব অন্ধকার।
কাকা, এত লোক…. আয়োজন কি করবে?
জ্যাঠাকে জিজ্ঞাসা কর….
জ্যাঠা কি করব?
কিছু তো খাওয়াতেই হবে…. খাওয়ার লোভে
হাঁটছে শালাগুলো…. নাম লিখে নিস... সেরকম হলে খিচুড়ি করে দিলে হবে... তোর বাবা কত দেবে
বলছে…
বাবা কত দেবে?
এক হাজার
কাকা কত দেবে?
এক হাজার
তুই কত দিবি?
পাঁচশো
এতে হবে? এতে হয়?
কি হবে তবে?
আগের মত মাইনে কই?
দাহ হচ্ছে। ভোর হব হব। কুয়াশায় ঘেরা
চারদিক। চিতার আগুনের হল্কায় গা সেঁকছে কেউ কেউ। পুব দিক লাল হচ্ছে। ঘুম জড়ানো চোখে
তাকিয়ে চিতার দিকে সবাই। শেষ হলে নাম লেখা হবে শ্মশানযাত্রীদের। ঘুমিয়ে পড়লে হবে না।
বাচ্চা কয়েকটা কাঁদছে। কাঁদুক। কানে বাজবে বারুইদের। ওদের ছেলে আজ যাবে কি কাজে? মাইনে
হয় মাসের আট তারিখ। কাজ হতে বাকি এখনও কদিন? তেরো না পনেরো? শ্মশানযাত্রীদের আলাদা
খাওয়া। আলাদা মিষ্টি দেওয়া হয়। চাইলে দুটোর বেশিও দেওয়া হয়। সূর্য উঠছে। আর কয়েকদিনের
অপেক্ষা। প্যাণ্ডেল হবে ওদের উঠানে। এতলোক ধরবে? না হয় মাঠে হবে। চেয়ার টেবিল দরকার
নেই। মাটিতে বসেই হবে।
শ্মশানের মাটি ভিজে শিশিরে। খালি পাগুলো
মাটি মেখে আড়ষ্ট বসে। কাজে ডাকে না কেউ। চারদিকে সব বন্ধ। কেউ বলছে সবাই মরবে। কেউ
বলছে কেউ কেউ মরবে। কে কখন কিসে মরবে কেউ জানে না। খিদের উপর খিদের বকেয়া জমে। কদিন
লাগবে সরাতে কেউ জানে না।
কার্তিক পুড়ে গেল। আশায় ভর করে উঠে
দাঁড়ালো শ্মশানযাত্রীরা।