ক'দিন আগে কাঁচরাপাড়ায় এক ঘিঞ্জিগলিতে দাঁড়িয়ে এক বন্ধুর অপেক্ষা করছি। সন্ধ্যে হয়েছে খানিকক্ষণ হল। একজন বাড়ির সামনে বসে বাসন মাজছে। একটা ছোটো প্লাস্টিকের টুল। পাশে ডিমের ট্রে-তে আগুন ধরানো, তাতে ধোঁয়া উড়ছে, ওতে মশা তাড়ানো হচ্ছে। সামনে তিনটে স্টিলের থালা। দুটো গ্লাস স্টিলের। আর একটা কড়াই আর একটা হাঁড়ি। একটা বাটিতে ভীমবার জাতীয় কিছু আছে। সেখান থেকে ছোবড়াতে মাখিয়ে বাসনে ডলছেন।
এ দৃশ্য খুব চেনা। কিন্তু লকডাউনের পর আমার কাছে শুধু চেনা না, এ কাজটার তাৎপর্যটাও বুঝি। আগে বুঝতাম না। মনে হত এই কাচাকাচি, রান্নাবান্না, বাসনমাজা, ঝাঁট-ন্যাতা দেওয়া চাইলেই করা যায়। সে কাজে কোনো উল্লেখযোগ্য শ্রম হয় না। এমনকি হয় তো সে কাজগুলো কেউ না করলেও এমনি এমনিই হয়ে যায়।
লকডাউন চিনিয়েছে যে আসলে তা হয় না। এই গরম পড়তে শুরু করেছে। এই সময়ের সেদিনের স্মৃতি যেন বাতাসে উষ্ণতায় মেশানো।
ওই মহিলার বাসনে সাবান মাখানো, জলে ধোয়া, আরেকবার করে সাবান দিয়ে আবার ধোয়া, ধুতে ধুতে কোমরটা-পিঠটা সোজা করে একবার টানটান করে নেওয়া, আবার ঝুঁকে পড়া…. এ সবটা আমি আমার শরীর দিয়ে জানি এখন। আগে হলে হয় তো অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতাম। বা অন্যমনস্ক হয়ে দেখতাম।
একটা সময়ে মনে হত বোধের প্রসার মানে অনেক পড়াশোনা। অনেক জানা। অনেক তথ্য। অনেক জ্ঞান ইত্যাদি। এখন বুঝি বোধের প্রসার মানে আসলে তাৎপর্য বোঝার শিক্ষা। এ আমাকে কেউ শেখাতে পারে না। অন্যের ব্যাখ্যায় আমার কিচ্ছু আসবে যাবে না যতক্ষণ না আমি নিজে থেকে তার তাৎপর্য বুঝছি।
যা কিছু আমার স্বার্থের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত তার তাৎপর্য বুঝতে বেগ পেতে হয় না। কিন্তু নিজের বাইরে বেরিয়ে অন্যের জীবনের সঙ্গে যুক্ত খুঁটিনাটি বিষয়ের তাৎপর্য কি বুঝি?
যে মানুষটা বাগান পরিষ্কার করতে আসে, তার একটা ভাঙা সাইকেল আছে। যে ঠাকুমা ঝোপেঝাড়ে শুকনো কাঠ কুড়াতে আসে, তার একটা ক্ষয়ে যাওয়া হাওয়াই চটি আছে। সেই ভাঙা সাইকেলটাকে বদলে তাকে একটা নতুন সাইকেল কিনে দেওয়াই যায়। কিম্বা পুরোনো হাওয়াই চটিটাকে বদলে একটা নতুন চটিও দেওয়া যায়। সামর্থ্য থাকলে সেটা কর্তব্যও। কিন্তু সেই ভাঙা সাইকেলটা বা সেই ক্ষয়ে যাওয়া চটিটার তাৎপর্য কী তাদের জীবনে সেটা না বুঝতে পারলে দেওয়াটা শুধু করুণা হয়। ভালোবাসা না। যার সঙ্গে মর্যাদার যোগ আছে।
একজন মানুষকে সমর্যাদায় বুঝতে গেলে তার জীবনে তার চটি-জামা-বটুয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ধর্ম, রুচি ইত্যাদির তাৎপর্য না বুঝলে তাকে কি সত্যিই বোঝা যায়? যায় না। ভুলটা সেখানে হয়। আমরা বিচার করে ফেলি, বোঝার আগেই। ফলে জানাশোনা হয়, কিন্তু পরিচয়টা আর হয়ে ওঠে না।
(ছবি Debasish Bose)