Skip to main content

দুপুরের রোদ এসে ছাদে পড়েছে। সঙ্গে শীতের হাওয়া। ব্রাহ্মণ উচ্চারণ করছেন, মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ... রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করে দিচ্ছেন…

      "বায়ু মধু বহন করছে, নদী-সিন্ধুসকল মধু ক্ষরণ করছে। ওষধি-বনস্পতিসকল মধুময় হোক, রাত্রি মধু হোক, উষা মধু হোক, পৃথিবীর ধূলি মধুমৎ হোক, সূর্য মধুমান হোক।"

      এত মধু এত আনন্দ নাকি জীবনের পরতে পরতে! রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, এ সৎকারের মন্ত্র, সমস্ত আসক্তির জড়ত্ব থেকে চিত্তকে মুক্তি দেওয়ার সাধন। এইতেই আনন্দ।

      যার বয়েস দু'য়ের ঘর পেরিয়ে তিনের ঘরই ছুঁলো না, তার সামনে, পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণের মাঝে মাঝে, সদ্য দৃষ্টির বাইরে যাওয়া তার মা-কে সম্বোধন করে যাচ্ছেন প্রেতাত্মা বলে। এই নিয়ম। আরো আছে। কোন হাতের দুধ গড়িয়ে কোন পিণ্ডির উপর পড়বে, কোন হাতের কুশ কোন আঙুলে কতবার পরিবর্তিত হবে। একটু খুঁত হলেই সে দেহ ছেড়ে যাওয়া মানুষটার নাকি ভীষণ ক্ষতি। এ সবের নাকি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। কিছুটা মনোবিজ্ঞান আর কিছু ভৌতবিজ্ঞান মিলে নাকি এ এক অদ্ভুত প্রথা। এ করতেই হয়। এতে শোকের একটা বিরাম ঘটে। তাই কি? জানি না। তবে তার ত্রাণের জন্য ব্রাহ্মণের পায়ে যে থেকে থেকেই নুয়ে পড়তে হয়, সে নিয়ে কারো কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। কেউ আশ্চর্যও হয় না।

      এ সবই সামাজিক প্রথা। সবাই জানে এ অর্থহীন। তবু এগুলো পালন করতে হয়। কারণ জীবনটা যে আদতে সম্পূর্ণ অর্থহীন - এতবড় সত্যিটাকে ভুলে থাকতে গেলে কিছু একটা খেলা নিয়ে তো বাঁচতেই হবে। মৃত্যু যখন তখন আমার ঘরে ঢুকে সব কিছু এলোমেলো করে দিয়ে চলে যাবে, আর আমি তা এমনি এমনিই হতে দেব? একদম না, আমি সব কিছুর একটা তত্ত্ব বানাবো। সেই তত্ত্বে একে উপরে চড়াব, তাকে নীচে নামাব। এর গলায় পাড়া দেব, ওর পায়ে পড়ে আরাধনা করব। সবাই ভাববে আমি একটা বিশেষ সত্যের হদিশ পেয়েছি, সে সত্যের খোঁজ আদতে সাধারণ কেউ পায়নি। সে সত্য কি? সে হল ইন্দ্রিয়াতীত জগতের সব সূত্র আমার জানা হয়ে গেছে, এমন সত্য। এমন ভানের সত্য। তবু অনেকেই তা বিশ্বাস করবে। কারণ যা প্রমাণ করা যায় না, তার উপরে মানুষের প্রবল আগ্রহ। কারণ তার কিছুটা আমার স্বার্থ, কিছুটা আমার ভয় আর কিছুটা আমার ইচ্ছা দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। একটা সিস্টেম বানিয়ে নেওয়া যায়। এই যেমন দাবাখেলা, কি ফুটবলখেলা, কি ক্রিকেটখেলা। সব নিয়ম আমাদেরই বানানো, তবু সেই নিয়মকে আমরা মেনে চলে সুখ পাই। সেই নিয়মের রাস্তায় হেঁটে কেউ জেতে, কেউ হারে। সব নীতিই তো আমাদের বানানো। সে রাজনীতি হোক, কি ধর্মের নানা আচার অনুষ্ঠান হোক, কি অর্থনীতি কি বিচার নীতি যাই হোক না কেন - আমাদেরই সৃষ্টি। তবে সেগুলো যুক্তির রাজ্যে দাঁড়িয়ে, আর ধর্মের জগতে সব বিশ্বাসের উপর।

      বিশ্বাস আগে, না উপলব্ধি? অবশ্যই বিশ্বাস আগে। বিশ্বাস না করলে কারোর উপলব্ধি হয় না। নইলে আরবে কেউ কালীর দর্শন পায় না কেন? আর নেদারল্যাণ্ডেই বা কেউ হরিনাম মাহাত্ম্য উপলব্ধি নিজে থেকে করে না কেন? কারণ ওসবে বিশ্বাস নেই, তাই উপলব্ধি নেই। তাই বিশ্বাসের সীমাবদ্ধতায় উপলব্ধিও সীমাবদ্ধ হয়ে যায় - দেশে, কালে। যেমন এই গেল শতাব্দীর বাংলার একজন মানুষ সমস্ত ধর্মকে 'এক' বলে বিশ্বাস তথা উপলব্ধি করলেও তা সার্বজনীন যে হয় না, তা এই কল্পতরু উৎসবের দিনে যে কোনো চিন্তাশীল বঙ্গবাসীর বুঝতে বেগ পেতে হবে না। যার বিশ্বাস নেই, এই একত্বে, তার উপলব্ধিও অন্যপথে।

      তবে কি বিশ্বাস বা উপলব্ধি অর্থহীন? না তো। একজন শিশু যখন বিনা ভাষায় কেঁদে ওঠে, তখন মা বোঝেন তার কি দরকার। এ বিশ্বাস, এ উপলব্ধি। কারোর চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতর মুচড়ে ওঠা, হ্যাঁ বা না, নিঃশব্দে পড়তে পারা, এও উপলব্ধি। এ না হলে মানুষ তো ছার, কথা বলতে পারে সে, পশুর সঙ্গে বাস করতাম কি করে আমরা? মনুষ্যত্ব উপলব্ধির বস্তু, কারণ সে একটা ভাব, শুষ্ক তর্কে তার দেখা মেলে না।

      আসলে তো মানুষের ভণ্ডামির শেষ নেই। এক হয় ভাষার ভণ্ডামি, দুই হয় ভাবের। যে কোনো রূঢ় অপ্রয়োজনীয় কথা বলে ফেলে নিজের স্বভাবের অকপটতার গুণকে জাহির করে, আদতে তা ভাবের জগতে ভণ্ডামি। কারণ সত্যের প্রতি অনুরাগের চাইতে আঘাতের ইচ্ছার প্রতি আকর্ষণ তার বেশি। কিছুটা অতিরিক্ত মাত্রাতেই বেশি। যা আছে তা শুধু ভয় আর প্রতিশোধস্পৃহার অনির্বাপিত আক্রোশ। সে সামাজিক হোক আর ব্যক্তিগত হোক।

      বছরের প্রথম দিনের সকাল। মুণ্ডিত মস্তক সে ছেলেটার সমব্যথী আমি। আমার সামনে কোনো সান্ত্বনা নেই। কোনো পরলোকের আশ্বাস নেই। আমার সামনে শুধুই ধূ ধূ বালি। মরীচিকা আছে, জল নেই। স্বপ্নের কোনো উদ্দেশ্য হয় না, সেই অর্থে স্বপ্ন নির্দোষ। তাই হয় তো তার কোনো প্রহরীও থাকে না। তাই যে মানুষ বা সমাজ স্বপ্নে বাঁচে তাদের ছাড় অনেক। কিন্তু জাগরণের দুই থাকে। সেখানে একমাত্র আশা, মানুষের পাশে দাঁড়ানো মানুষ। সে কবিতাই যে না হল। তসলিমা নাসরিন লিখছেন,

      "মা বলেছিলেন বছরের প্রথম দিনে কাঁদিস না,

         কাঁদলে সারা বছর কাঁদতে হবে।

মা নেই।

সারা বছর কাঁদলেই কার কী?"

      সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছি। দেখলাম বাইরে রোদে চেয়ার পেতে বসে সদ্য চলে মানুষটার শাশুড়ি। ছলছল চোখ। বললেন, "আমি মেনে নিতে পারছি না। আমি ও দৃশ্য দেখতে পারব না। আমি ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। আমি মেনে নিতে পারছি না।"

      আমি কিছু বললাম না। মাথা নাড়লাম। আমরা তো আসলে কেউই মেনে নিতে পারি না। মৃত্যু এইখানেই হেরে যায়। কারণ আমরা না মেনেও তবু হাঁটি, তবু চলি, মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে বলি, তুমি সত্যিই আর যেই হও, মৃত্যুর চেয়ে বড় নও। রবীন্দ্রনাথের মত করে বলি। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মের চাইতে তার গানের সুর আর কবিতার আশ্বাস আমাদের কাছে যে বেশি দরকার। সেটুকু অন্তত তার ব্রহ্মও বোঝেন। তাই তিনি হারিয়ে যেতে পারেন না। এমনকি আজ সংস্কৃতির জগতে যে ঝড় উঠেছে সেও পারে না তা আড়াল করতে। ঝড় তো ঝড়ই। শ্বাসের বাতাস তো নয়।