কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর জল খেতে উঠছিল পার্থ। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে কেন থেকে থেকে বুঝতে পারছে না। মাথাটাও ভার ভার লাগছে। কাল রাতে অবশ্য ঘুমটা খুব ছাড়া ছাড়া হচ্ছিল। কোনও বাজে স্বপ্ন দেখেছিল কি? মনে করতে পারছে না। তবে অস্বস্তিটা ঘুম থেকে উঠেই। সব কিছু থেকে কিরকম একটা ছাড়া ছাড়া লাগছে নিজেকে। মাথাটাও ঘুরছে। পড়ে যাবে মনে হচ্ছে বেশি হাঁটলে। কোনও কঠিন রোগটোগ হচ্ছে কি? পার্থর আবার নার্ভাস লাগছে। রোগের ব্যাপারে পার্থ খুব নার্ভাস।
আবার উঠে জল খেল। এত দেরি করছে কেন আসতে? ঘড়ি দেখল। তিনটে পাঁচ। গরমটা তেমন পড়েনি যদিও। ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহ। রোদটা তেমন চড়া না। পার্থ রুমাল বার করে ঘাড়টা মুছল। ঘামছে, গরমে না। ভয়ে। কিন্তু কিসের ভয়? ভয় ঠিক না। আতঙ্ক। এখুনি যেন কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। কিন্তু কি ঘটবে? সে মারা যাবে? হার্ট অ্যাটাক হবে? হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আগে কিরকম লাগে মানুষের? বুকে ব্যথা হয়। তার হচ্ছে? না। ঘাম হয়, এই তো হচ্ছে। পার্থর কানের কাছটা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। আরো ঘাম হচ্ছে। পাশে বসে দু'জন কি নিয়ে যেন কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। পার্থ তাকালো, একটা বুড়ো লোক একটা কম বয়েসী লোকের সাথে কিছু বিয়েবাড়ি-টাড়ি নিয়ে আলোচনা করছে। ওরা এখন তার সাথে কথা বলবে না। সে চেষ্টা করলেও বলবে না। অথচ একটু কথা বলতে পারলে পার্থর মনে হচ্ছে একটু অন্যমনস্ক হতে পারত। পার্থ উঠে এগোলো। সিগন্যাল লাল। আপ-ডাউন দুদিকেই। সে ডাউন প্ল্যাটফর্মে। হালিশহর স্টেশানে। আপ প্ল্যাটফর্মটাও ফাঁকাই প্রায়। শেডের তলায় কিছু লোক বসে, আর তিনজন চারজন এদিক ওদিক। পাখা ঘুরছে। কয়েকটা কুকুর অকারণে প্ল্যাটফর্মের এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে। অকারণে? কুকুরদের দৌড়ানোর সব সময় কারণ থাকে? আচ্ছা আমি যদি কুকুর হতাম? কি এমন পার্থক্য কুকুরের সাথে মানুষের? কিছুই তো না। সেই আহার-নিদ্রা-মৈথুন। পার্থ তার পাশে রাখা বাদামের ব্যাগটা দেখল। কুকুরে বাদাম খায়। মানুষেও খায়। খিদে সকলের এক রকম। সে কুকুরের চোখের দিকে তাকালে বুঝতে পারে, ওদের খিদের তাকানো। ভিখারীদের চোখেও ওরকম একটা চাওনি থাকে। তার নিজের চোখেও দেখেছে। মায়ের আর বোনের চোখেও। আজ সব মিলিয়ে কত টাকার বিক্রী হল? দেড়শো হবে।
পার্থর মনে হচ্ছে তার বাঁ বুকের কোণাটা চিনচিন করে ব্যথা করছে। গ্যাসেরও তো হতে পারে? ছত্রিশ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাক হয়? হয় না আবার হয়ও। তবে তাদের বংশে তো হার্টের রোগ। বাবার ছিল, ঠাকুর্দার ছিল, কাকার আছে। বাবার মৃত্যুটা মনে পড়ল পার্থর। সে তখন মাঠে খেলছিল। পূজোর দশদিন আগে। হঠাৎ খবর এলো বাবা কলকাতায় বাসে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। শ্যামনগর থেকে বাবা রোজ যাতায়াত করতেন হাওড়ায়। একটা জুটমিলে কাজ করতেন। বাসে শিয়ালদহ আসতেন। পরে শুনেছে বাবাকে মহাত্মাগান্ধী রোডের ধারে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। প্রচণ্ড ঘাম হচ্ছিল নাকি। রাস্তায় কেউ সাহায্য করেনি। অনেক পরে একজন ট্র্যাফিক পুলিশ ধরে মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। কিন্তু রাস্তাতেই যা হওয়ার হয়ে গেছে। মারা যাওয়ার আগে নাকি বাবা তার নাম ধরে ডাকছিলেন অনেকক্ষণ... দীপু... দীপু...( পার্থর ডাকনাম)
এটা কেউ বলেনি, সে নিজে নিজে ভেবেছে। ভাবতে ভাবতে এখন সেগুলো সত্যিই হয়ে গেছে। মানুষ সত্যি- মিথ্যা বানাতে পারে, ভাবনায়। ভাবনাটা এখন তাকে আর তাড়া করে না। আগে ঘুমাতে পারত না। সে উচ্চ-মাধ্যমিকে ব্যাক পেল। আর পরীক্ষা দিল না। দুটো নেশা তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল সেসময়। এক বিড়ি আর দুই হস্তমৈথুন। পাগলের মত হয়ে যাচ্ছিল। মনের ভিতরের সব ঝাল ওতেই ঝরে পড়ত। প্রত্যেকবারই বীর্যপাত হয়ে যাওয়ার পরপরই ভীষণ কান্না পেত তার। বাবার মুখটা ঠিক ওই সময়টাতেই দেখতে পেত, চোখের সামনে, বলত - কিছু একটা কর বাবু...কিছু একটা...। মদও ধরে ছিল তারপর। ওই মদের ঠেকেই তো বিশুদার সাথে আলাপ। সেই এই রাস্তায় নামালো তাকে, মানে এই হকারির লাইনে।সোনাগাছির রাস্তাও বিশুদার দেখানো। তবে ওসব সে বেশীদিন করতে পারেনি। বিচ্ছিরি রকম জ্বর হল একটা। জণ্ডিস আর টাইফয়েড একসাথে। সে ভেবেছিল এইডস। কণ্ডোম ফেটে হয়তো বিষমাল ঢুকেছে তার রক্তে... সে তাই ভেবেছিল। কল্যাণী জওহরলাল হাসপাতালে পড়েছিল পনেরোদিন। কল্যাণীতে ওর মামাবাড়ি।
বুকের ব্যথাটা গ্যাসেরই হবে। কখন অ্যানাউন্স করেছে খেয়াল করেনি, হুসহুস করে একটা মালগাড়ী বেরিয়ে গেল ডাউনে। স্টেশানে লোকের সংখ্যা বেড়েছে। আপেও। আপে এখন একটা রাণাঘাট লোকাল আছে। ডাউনে কৃষ্ণনগর। পার্থ দেখল একটা কুকুর তার ব্যাগটা শুঁকছে। পাবে না কিছু। সে তাড়ালো না। তার বাবা কুকুরের মত রাস্তায় পড়ে মরেছে, সাধনদা বলেছিল। তার বোন কুহেলীর সাথে নোংরামো করত সাধনদা। একদিন পার্থ আইপিল দেখে ফেলে কুহেলীর ব্যাগে। কুহেলীর তখন ফার্স্ট ইয়ার। পাস কোর্সে। সাধনদাই নাকি বোনের বুকটা অতবড় করেছে, ক্লাবে মাল খেয়ে পটলা বলেছিল। সাধনদা এখানকার এমএল-এর ছেলে। বাড়ির সব পাল্টে গেছে। মা-ও। মানুষও কুকুরের মত। অনেকদিন নিরামিষ খেতে পারে না। মানুষের মধ্যেও কুকুর থাকে একটা। কুকুরেরা জানে। মানুষেরা না।
পার্থর প্রচণ্ড জোরে হিসি পাচ্ছে। এবার তার শরীরটা সুস্থ লাগবে। হোটেলের মাছটা ঠিক ছিল না। তাছাড়া আজ সকাল থেকে চা-বিস্কুট ছাড়া খাওয়াও হয়নি কিছু তেমন, তাই গ্যাস হয়ে গিয়েছিল। পার্থ আবার এসে শেডের তলায় বসল। মাথাটা হাল্কা এখন। ঘাম হচ্ছে না। বুকটা ব্যথাও করছে না। মরল না?! পার্থ'র ভালো লাগছে চারদিক তাকিয়ে। কুহেলীর মুখটা মনে পড়লে কান্না পায়। ছোটোবেলা থেকেই মেয়েটা একটু ভালো খেতে আর পরতে ভালোবাসে। এটা কি খুব বেশি চাওয়া?
পার্থর বুকের কাছটা চাপচাপ লাগল। এটা রোগ না। এটা ভালোবাসা। ভালোবাসা অসহায় হলে বুকে চাপ লাগে। কি পাপ করেছে তার মা বোন? কিচ্ছু না। পাপের মধ্যে শরীরের নীচের দিকটা চুবিয়ে বাঁচার জন্য বাতাস নিতে চাইছে শরীরের উপর দিকটা বাঁচিয়ে। এই তো? আর সাধনের বাচ্চারা শালা ******। মুখসমেত মাথাটা পাপের মধ্যে চুবিয়ে বিষাক্ত রস খেয়ে বেঁচে আছে। পার্থর মনে হয় এখন, শরীরের নীচেটা দিয়ে যা হয়, তা পাপ নয়, অবস্থার বাধ্যতা। আর মাথা দিয়ে যারা পাপের বিষাক্ত ফল খেয়ে বাঁচে, তারাই আসল পাপী। যদিও সমাজে উল্টো নিয়ম। কুকুরদেরও সমাজ থাকে। বড়মানুষদের সুবিধার ব্যবস্থাকে সমাজ বলে। বড়লোকদের জন্য সমাজ, তাদের জন্য পাপ।
কুকুরটা ব্যাগটা শুঁকছে। পার্থ ব্যাগটা খুলে একটা বাদামের প্যাকেট ছিঁড়ে ওর সামনে দিল। কিছু লোক কিছু মন্তব্য করল বুঝতে পারল। সে জানে ওরা কি বলল। বলুক। লোকেদের কথা থুতুর মত লাগে। স্নান করলেই ধুয়ে যায়। কিছু কথা পানের পিকের মত। লাল রঙের দাগটা ধোয় না। সেটা বিষাক্ত ভালোবাসা। যার থেকে ভালোবাসা চায় তার থেকেই পানের পিকের মত কথা আসে। যন্ত্রণাটা পিকের দাগের মত উঠতে সময় লাগে।
ট্রেন দেখা যাচ্ছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে মন্টা। পকেটমার। তার এই মোবাইলটা মন্টাই দিয়েছে। তখন সে হাওড়া-ব্যাণ্ডেল লাইনে কাজ করত। মন্টাও পাপী না। ও শ্রমিক। কাজ পায়নি। জলকে আটকালে বন্যাই হয়। বন্যা মানে পাপ না। অব্যবস্থা।
পার্থ ট্রেনে উঠল। এই তিনটে কামরায় কাজ করবে সে ব্যারাকপুর পর্যন্ত। একটা বাচ্চা তার দিকে তাকিয়ে। কিনবে বোধহয়। মানুষের খিদে পায়। কুকুরের মতই পায়। আর খিদে পেলে সবাই কুকুরের মত তাকায়, বড়লোক আর গরীবলোক আলাদা করা যায় না, চোখ দেখলে আলাদা করে বোঝা যায় না। ট্রেন নৈহাটী ঢুকছে। পার্থর ভীষণ ভালোবাসা পাচ্ছে। সব লোককে জড়িয়ে চুমু খেতে ইচ্ছা করছে। বাদামের ব্যাগটা ফেলে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। ওই দরজার ধারে বসা মানুষগুলো টিকিট কাটে না... ওই ভিখারীরা রেওয়াজ করে না... ওরা সবাই শুধু বাঁচতেই চায়... কাউকে না বিরক্ত করেই... ওদের জন্যে একদিন সে এই ব্যাগ ভরতি বাদাম ফেলে রেখে চলে যাবে... খুব ইচ্ছা করে তার...
বাদাম... সল্টেড বাদাম...