শকুন্তলাদেবী বলতেই প্রথম কোন শব্দটা মাথায় আসে? বিস্ময়। আমার ক্ষেত্রে এ বিস্ময়ের মাত্রা আরো বেশ কিছুগুণ বেশি অবশ্যই, কারণ আমার সাংখ্যতত্ত্বের সাথে বনিবনা হলেও, সংখ্যাতত্ত্বের সাথে বনিবনা কিছুতেই হল না জীবনে। তো যে কথাটা বলছিলাম, শকুন্তলাদেবী বলতেই প্রথম কোন শব্দটা মাথায় আসে? বিস্ময়।
যখন প্রথম শুনলাম শকুন্তলাদেবীকে নিয়ে সিনেমা হচ্ছে, মনে মনে ভাবলাম, কি করে হবে? একজন মানুষ সারাদিন শুধু এ দেশ ও দেশ ঘুরে অঙ্ক করবে আর তাই দেখেই যেতে হবে? হুম শুনেছি বটে উনি হোমসেক্সুয়ালিটির ওপর বই লিখেছেন, কিন্তু সেই নিয়ে যে পরে একটা বিশাল অন্দোলনে জড়িয়ে থেকেছেন তাও তো নয়। তবে? বাকিটায় কি দেখানো হবে? এদিকে না দেখেও তো থাকা যাবে না, কারণ? কারণ বিদ্যা বালান। কেন বিদ্যা বালানকে ভালো লাগে? এর অনেক মিথ্যা উত্তর হয়। তবে আসল উত্তরটা হল, বিদ্যা বালানকে ভালো লাগে কারণ বিদ্যা বালান, বিদ্যা বালান বলেই।
তো ভয়ে ভয়ে দেখতে শুরু করলাম। কত অঙ্ক দেখতে হবে রে বাবা! কিন্তু দেখতে দেখতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখলাম, না তো! পরিচালকের গল্প বলার টোনটাই আলাদা। সংকর নয়, মানে এই যেন কেঠো বাস্তব, ওই যেন হালকা-ফুলকা। উঁহু, উনি মোটেই গুলিয়ে দেননি। ভয়ংকর বাস্তবসম্মত দৃশ্য, সংলাপ ইত্যাদি ইত্যাদি নয়। বাস্তবের মধ্যে কি ম্যাজিক দেখানো যায়? বাস্তবের মধ্যে কি বিস্ময় সৃষ্টি করা যায়? যায়। যদি কোনো বাণী থাকে, যদি মহৎ কোনো চরিত্রের ব্যাখ্যান থাকে, যদি সাংঘাতিক দেশপ্রেম, ঈশ্বরপ্রেম, মানবপ্রেম ইত্যাদি কোনো গুণসমন্বিত চরিত্র হয়ে থাকে। তবে তো চরিত্রের মহত্বেই দর্শকের আসনে ফেভিকুইকের মজবুত জোড় লেগে গেছে। কিন্তু যদি এমন একজন চরিত্র হয়, যার তেমন কোনো গুণ ভারতীয় সমাজ স্বীকৃত যা যা সেই অর্থে তার নেই, অথচ একটা অসম্ভব, চিরাচরিত ধ্যানধারণা বিরোধী সাহস আছে? তখন? আচ্ছা, সে হলেও না হয় হত। কোনো গুণ তো নেই-ই, বরং এমন কিছু দোষ আছে, থুড়ি দুর্বলতা আছে, যা মনুষ্যজাতির দুর্বলতা হিসাবে স্বীকৃত গোটা বিশ্বে, কিন্তু মেয়েদের দুর্বলতা বলে ক্ষমাযোগ্য নয়! যেমন স্বার্থপরতা, যেমন নিজের দরকারে মিথ্যাভাষণ, যেমন অত্যন্ত ইম্পালসিভনেস, যেমন নিজের সুখটাকে বড় করে দেখা, যেমন গোটা বিশ্বকে নিজের দাঁড়ায় মাপতে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন পরিচালক কি করে? হুম, যেটা করার সেটাই করেছেন, কোত্থাও কিচ্ছু জাস্টিফাই করতে যাননি। শুধু গপ্পোটা বলে গেছেন। কিসের টোনে? বিস্ময়। মানুষটা তো শুধু অঙ্কের যাদুতেই বিস্ময় সৃষ্টি করেছে তা তো নয়, জীবনের নানা বাঁকে বাঁকেও করেছেন। ঠিক না ভুল? ধুর মশায়? বিস্ময়ের আবার ঠিক-ভুল হয় নাকি?
তবে এটা আমি কি লিখলাম, সিনেমার রিভিউ? মোটেই না, আমার ভালো লাগাটার শেয়ারিং। অনেকেই বলবেন, অনেক জায়গায় সত্যভ্রষ্ট হয়েছে। এতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমি আজ অবধি একটা বায়োপিক দেখিনি, যেটা হওয়ার পর কেউ বলেনি, আরে এই জায়গাটা থোড়ি এরকম ছিল? সত্যভ্রষ্ট করা হয়েছে।
অগত্যা মোদ্দা কথা আমার ভালো লেগেছে। আর বিদ্যা বালানকে নিয়ে কি আর বলা! কোনো মহিলাকে অনেক লড়াই করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর গল্পে অন্তত একটা সহানুভূতি জানানোর জায়গা থাকে, সেইটুকু আমাদের নিজেদের জায়গা। নিজেদের মহত্ব, সুবিবেচনা দেখানোর কৃতিত্ব যাই বলা যায় না কেন, তার জায়গা। কিন্তু এমনি এমনি মিছিমিছি আনন্দে সাবলীলতায় কোনো মহিলা ঘাড় উঁচু করে দাঁড়ালে, কোথায় যেন একটা খটকা লাগে, রিপিটেটিভ লাগে, বিশ্বাস হয় না, একঘেয়ে লাগে। আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করি, অনেক লড়াই করতে হয়েছিল না? সে যখন একগাল হেসে বলে, লড়াই, কার সাথে? তখন আমি আমার পরাজিত পৌরুষের দিকে আঙুল তুলে অন্তত নিজের শত্রুপক্ষের গুরুত্বটুকু, মর্যাদাটুকু চাই তার কাছে। কিন্তু সে যখন বলে, ধুর, আপনি ছিলেন? আমি তো খেয়ালই করিনি, তখন? তখন এই অস্বাভাবিক কোমল ত্বকের ঔদ্ধত্যকে কি ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায়? তখন ঠোঁট বেকিয়ে বলতে হয়, ছাড়ুন তো!