Skip to main content
sakkhi

কথা শেষ হওয়ার আগেই তো সে উঠে গিয়েছিল। একটা বেড়াল জানলায় বসে। আমার অপ্রস্তুত লাগছিল। বেড়ালটা আমার দিকে তাকিয়ে, ওদিকে ও চলে যাচ্ছে।

ডাকলাম না। বেড়ালটাকেও তাড়ালাম না। শুধু ঘরটা অন্ধকার করে বসে থাকলাম। বেড়ালটাও কোথাও গেল না। এমনকি যখন বাইরে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল, তখনও সে জানলা ছেড়ে বাইরে গেল না।

কলিং বেল বাজল। উঠে দাঁড়ালাম। বেড়ালটা তাকালো। অন্ধকার ভেদ করে তাকালো। আমি দরজার দিকে এগোলাম। বাইরে দাঁড়িয়ে সে। ভিজে চাপ চাপ।

বললাম, এসো।

মনে ভয় ছিল। আবার তো চলে যাবে। যে কোনো সময়। আমায় কিছু না বলে। কিম্বা শুধু "আসছি" বলে। কোনো কারণ ব্যাখ্যা না করে।

ঘরে এলাম। সে বাথরুমে গেল। শুকনো জামাকাপড় নিয়ে। চেঞ্জ করে আসছে।

বেড়ালটা নেই।

রাত অনেক। সে ঘুমাচ্ছে। আমি জেগে। জানলার দিকে তাকিয়ে। বেড়ালটা কই? ঠুক করে আওয়াজ হলে সজাগ হয়ে যাচ্ছি। কই সে?

সে ঘুমাচ্ছে। পাশ ফিরল। উঠল। জল খেল। আবার শুয়ে পড়ল। এবার উপুড় হয়ে।

রাত তিনটে। বেড়ালটা নেই। সকাল হলে সেও চলে যাবে। ফাঁকা ঘরে আমার একা চিন্তা, একা অনুভব, আমার একা শ্বাসপ্রশ্বাস, আমার একা জৈবনিক প্রক্রিয়া। সব আছে, তবু যেন আমি নেই। সেও নেই। বেড়ালটাও নেই। যা আছে, সে শুধু ফাঁকা ছাদের মত সময়। একা। অলস পড়ে।

ভোর হল। আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। সে নেই। বিছানা এলোমেলো। বোতলে জল নেই। সবটুকু খেয়ে গেছে। যাক। ফাঁকা বোতলের ভিতর দিয়ে জানলাটা দেখা যাচ্ছে। বাগানের সবুজ রঙ বোতলে মাখামাখি। অস্পষ্ট। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল ওই অস্পষ্ট সবুজ রঙও আমার দিকে তাকিয়ে। কেউ সব সময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন কেউ। কে সে? সে যে কেউ হতে পারে। পাপোশ, ফাঁকা বোতল, ছাদ, জানলার রড, পড়ে থাকা ফাঁকা সিগারেটের প্যাকেট। আমাদের একাকীত্বের সাক্ষীও যেন আমি একা নই, আরো একজন কেউ, বা কারা। যে বা যারা তাকিয়ে থাকে। নির্নিমেষ।

রোদ এসে পড়ল এলোমেলো বিছানায়। বেড়ালটা কোথাও নেই। বাগানে, ছাদে, বারান্দায় - সব জায়গায় ঘুরে এলাম, নেই। যেখানে যেখানে তার থাকার কথা, সে নেই, আর নেই বলেই যেন সেখানে সে বেশি করে আছে। যার যেখানে থাকার কথা সে কেন সেখানে থাকে না? তার না থাকাটা তখন এক দমবন্ধকর থাকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অনড়। অসহ্য! মানুষ সব কত কিছু অসহ্য বলতে বলতেও সহ্য করে যায় সব। কি অগোছালো মানুষ। কি এলোমেলো!

রোদ থাকবে না ঘরে বেশিক্ষণ। বাগানেও থাকবে না। তার চটির দাগ বাগানের নরম মাটিতে। তার চলে যাওয়ার দাগ। বৃষ্টির জল এখনও পাতা চুঁইয়ে মাটিতে পড়ছে, বিন্দু বিন্দু।

আচমকা বাগানের ঝোপে কি আওয়াজ হল। বেড়ালটা তো! ঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে, স্থির হয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে। কি করবে? চলে যাবে? না আসবে? বসবে বারান্দায়? কি করবে ও?

বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে। রোদ খামচে ধরে আছে জবাগাছ, পেয়ারাগাছ। তবু চলে যাব, রোদ।

পা টিপে টিপে ঘরে এলাম। দরজা খুলে রাখলাম। যদি আসে। যদি জানলায় এসে বসে। যদি বারান্দায় এসে বসে, পাপোশে। কিম্বা যদি ছাদে ওঠে সিঁড়ি বেয়ে।

রোদ সরছে। দরজা খোলা। আমি বসে আছি। বসে বসে তিনজনকে দেখছি। তাকে, বেড়ালটাকে আর নিজেকে। কেউ চোখের সামনে নেই। রোদ সরে যাচ্ছে। খোলা দরজা অল্প অল্প দুলছে বাতাসে। ভিজে বাতাসে। আমার অপেক্ষার সাক্ষী আমি। যদি আটকে দিতাম দরজা। যদি কাউকে যেতে না দিতাম, তবে সাক্ষী থাকত সবাই। একা অপেক্ষার সাক্ষী আমি। শুধু আমিই। আমি সরে সরে যাই না? আমি কি স্থির বিন্দু? কেউ কি তাকিয়ে নেই আমার দিকে?

চিন্তা, অনুভব, আমি। ব্যস্ত রাস্তা। পার হতে চাইছে একটা পা ভাঙা কুকুর। কোনোদিন পার হবে কি? নাকি চাপা পড়ে মরে পড়ে থাকবে মাঝরাস্তায়? কেউ জানে না।

 

(ছবি : ত্রারেত)