১
-----
ঘটনার সময়কাল ১৯৪০ সাল। বাংলাদেশের একটা ছোটো গ্রাম। মেয়েটা বিয়ে হয়ে গ্রামে এল ঘোর বর্ষা মাথায় করে। মেয়েটার নাম শিবানী। তার বরের সাথে পরিচয় হওয়ার আগে হল পরিবারের সাথে পরিচয়, গ্রামের সাথে পরিচয়। সেবারে ধান হল গোলা ছাপানো। লোকে বলল - লক্ষী।
শিবানী মাসকয়েক পর জানল, শুধু সে না, তার স্বামীর রাতে আছে অনেক নারী। কেউ ও গ্রামের, কেউ শহরের, কেউ খারাপ পাড়ার বারাঙ্গনা। মেয়েটার বুক উঠল কেঁপে।
"স্বামী হল পুরুষ মানুষ। সব পুরুষেরই কি আর এক নারীতে চলে, হতভাগা মেয়ে?" সবাই দিল গোপন নিদান - গ্রামের মেয়ের আত্মসম্মান রোগের। "সিঁথির অধিকার? সে তো ভাত কাপড়ের, মাথা গোঁজবার ঠাঁই, রীতি শুধু সমাজে টিকে থাকার। এরপরও কি চাও বাছা? স্বামী থাকবে রোজ রাত্তিরেই ঘরে? কেন গা? তুমি কোন ডানাকাটা পরী? না স্বগ্গফেরত অপ্সরা গা?!"
তাই তো ঠিক। সে কি সত্যি পরী? না অপ্সরা? না বেহুলা? সে তো দু'বেলা ভাত খাওয়া, মাঠে হাগা, পুকুরে স্নানা, শরীর খারাপে ন্যাকড়া লাগানো সামান্য এক নারী!
২
-----
মেনেই নিল। বছর পেরিয়ে পেরিয়ে পর পর দুই ছেলে হল। "ওগো এ যে শুধু লক্ষী না! এ যে বংশের প্রদীপ আনা পয়মন্ত সতী!"
শিবানী তবু সুখী। সে বুঝে নিয়েছে ভাগ্যের সাথে অসম লড়াইয়ে শুধু ফাঁকি ফাঁকি ফাঁকি। তাই অনেক কেঁদে, অনেক ভেবে, একরকমে করে নিয়েছে সে রফা। বাঁচবে মাথা উঁচিয়ে। যে যাই বলুক। সে থাকবে নিজের মত সংসারে, শুধু সংসারকেই নিয়ে। সব স্বপ্নগুলো, উচিৎগুলো কুলুঙ্গিতে রেখে, বাঁচবে শান্তিতে।
ছেলেরা হল বড়। আসল আরেক অশান্তি। দেশভাগ হবে। তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে হবে কলকাতার দিকে। তাই হল অবশেষে। স্বামী বসলেন বেঁকে। "যাব না আমি" - শেষ সিদ্ধান্ত জানান দিলেন, শিবানী শুনল বিনা ভ্রুক্ষেপে।
৩
-----
ভারত স্বাধীন হওয়ার বেশ কিছুকাল পরে ভারতে এলেন, হাওড়ার এক বস্তিতে। শুরু হল নতুন লড়াই। দুই ছেলের পড়াশোনা, চাই মাথা গোঁজবার ঠাঁই। তাও হল। বস্তির এক ঘরে। এরপরটা অন্যরকম।
শিবানীর ভাই, অনেক বড় মানুষ তখন। একদিন এল দিদির খবর নিতে। সেও তখন এসেছে এদেশে। দিদিকে বলল, "আমার সাথে চল।" দিদি বলল, "না। এ আমার সংসার, প্রাণ বেরোবে এই পরিবারেই থেকে।" ভাইয়ের চোখ জলে গেল ভরে। দিদির কপাল চুমে, বাড়িতে গেল ফিরে। আরেক গল্প আছে। যা চলেছে এরই নেপথ্যে, গোপনে পা ফেলে, নিজের মহত্বকে ঢেকে। শিবানীর এক দেওর। নিজেই মাথা পেতে নিল পরিবারের জোয়াল। বৌদি হলেন, সীতার তুল্য। ভাইপোগুলো প্রাণ, এই মানুষটার যাদুমন্ত্রে সংসারে লাগল জোয়ার টান। কি পরিশ্রম, কি সে ত্যাগ - যা পুরাণকালেই মেলে, দু'হাত দিয়ে আগলে রাখল, সব অভাব বুকে টেনে। মিলের সামান্য কর্মচারী, ক'টাকাই বা মাইনে। চলল সবার পড়াশোনা, সে ছুটল, না চাইল বাঁয়ে, না ডাইনে।
শিবানী বুঝল। বস্তিবাসী কটুকথা তো বলবেই। জেদ ধরল, এ বছরেই দেওরকে সে বিয়ের পিঁড়িতে বসাবেই। বসালো সে। হয়ে গেল বিয়ে। যদিও অভাব ছিল, তবে এরই মধ্যে আরেক আপদ আবার দেখা দিল।
স্বামী ফিরলেন এ দেশেতেই, হয়ে নাস্তানাবুদ। স্বভাব ফিরল তার সাথেতেই, যে কামুক সে কামুক।
উপসংহার
------------
অনেক বছর পার হল। শিবানীর এখন ভরা সংসার। দুই ছেলে প্রতিষ্ঠিত। তাদের ছেলেমেয়েতে ঘর গমগম। ছেলেরা চাকরী পেতেই ভদ্রপাড়ায় ঘরভাড়া করেছে। শিবানীর দেওরেরও ভরা সংসার। দেওর তাকে এখনও রোজ সকালে প্রণাম করতে আসে। বৌদিকে বলে, "দেখ, দাদা আমাদের গুরুজন, তিনি অন্যায় করলেও তিনি বড়, তাই দেখো তোমার ছেলেরা ওনাকে যেন অসম্মান না করে।"
শিবানী 'হাঁ' করে দেওরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি দিয়ে বিধাতা এ মানুষটাকে গড়েছিলেন! তিনি মাথা নেড়ে বলেন, "না ঠাকুরপো, ওরা অসম্মান করে না।" ব্যস, অমনি দেওরের মুখে প্রসন্ন হাসি।
শিবানী ঠিক বলেছে। তার ছেলেদুটো তাদের বাবাকে অসম্মান করে না ঠিক। তবে কাছেও ঘেঁষে না। এমনকি নাতিনাতনিরাও না। অথচ শিবানী কাউকে কিচ্ছু শেখায়নি। আজ কত বছর এই মানুষটার সাথেই কাটিয়ে দিল - ঘেন্না রাগ অভিমান সবকিছুকে নিজের বুকে দাবিয়ে রেখে।
অবশেষে এল মাহেন্দ্রক্ষণ। স্বামী মারা গেল। শিবানী সে বছরেই সত্তর পড়ল। পাড়ার সব লোক এল, আত্মীয়স্বজন এল। স্বামীকে শোয়ানো বাইরের বারান্দায়। শিবানী ডুকরে কেঁদে উঠল। বুকের ভিতর থেকে সেই আদিম রোগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল - আত্মসম্মান রোগ। মুখে আঁচল চেপে বলল, "তবু ক্ষমা চাইল না, একবারও বলল না - ওগো আমি সারাটা জীবন যত কষ্ট দিয়েছি সব ক্ষমা করো।"
শিবানী হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। আবার বলল, "ও যদি একবারের জন্য আমার কাছে ক্ষমা চাইত, আমি সব ক্ষমা করে দিতাম, সব সব সব..."
বড়বউ এগিয়ে এলো, শাশুড়িকে বুকে চেপে বলল, "মা ওকথা বলবেন না। মা চুপ করুন।"
শিবানী চুপ করল। রোগ থাকতেই পারে, বাইরে তার লক্ষণ না এলেই হল।
শিবানী সংসারকে করুণা করতে শুরু করল সেদিন থেকে। এত করুণা নেবে সংসারের সে যোগ্যতা কই? শিবানী ফুরিয়ে গেল। মারা গেল আচমকাই, প্রায় বিনা ভূমিকায়।
আমার আজও মাঝে মাঝেই শিবানীর মুখটা মনে পড়ে। মনে হয়, পায়ে পাঁক লাগলে ছাড়িয়ে এগোনো যায়, যে সমাজ পাঁককে মাথায় করে রাখে, সে সমাজে আরো কত কত শিবানী আজও দঁকে আটকে। কি জবাব দেবে এ সমাজ মহাকালের কাছে?
(ছবিঃ সুমন)