Skip to main content

যিনি সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন আমি তাকে চিনতাম না। কোনোদিন নাম শুনিনি। তার জন্য আমার কোনো লজ্জাও নেই। কারণ সাহিত্য আমার কাছে সাধারণ জ্ঞান না। তৃষ্ণার জল। আমার মন শান্ত হয়েছে, ভালো হয়ে গেছে, শক্তি পেয়েছে, খুশী হয়েছে এমন অনেক অনেক লেখা পড়ে যারা কেউ নোবেল পাননি।

    একটা বয়েস ছিল, অনেক অল্প বয়েস, যখন বিখ্যাত বইয়ের দিকে ঝোঁক ছিল। কারণ সেদিন মনে বিখ্যাত হওয়ার বাসনা ছিল হয় তো কোনো কোণে। সে ঘোর অনেক অল্প বয়সেই কেটে গেছে। বাঁচিয়ে দিয়েছে কবিতারা। সাহিত্যে আর কোনো ধারার কাছে অত ঋণী নই যতটা কবিতার কাছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের 'গীতাঞ্জলি'র চাইতেও ঋণী এমন অনেক কবিতা বা প্রবন্ধের কাছে যার জন্য উনি নোবেল পাননি। ওই যে বললাম, সাহিত্য আমার কাছে তৃষ্ণার জল। সে আমার বাড়ির পাশের কলের কি পুকুরের হলেই হয়, আটলান্টিক বা প্রশান্ত মহাসাগরের বা হিমালয়ের কোনো বিখ্যাত চূড়ার বরফগলা জল হতেই হবে এমন কোনো মানে নেই।

    কবিতা বাঁচিয়ে দিয়েছে, বললাম না? হয় তো নীরেন্দ্রনাথ, সুনীল, শঙ্খ, নির্মলেন্দু, অরুণ, তারাপদ প্রমুখ লেখকেরা তত বড় লিখিয়ে নন, মানে যেমনটা হলে অনুদিত হয়ে নোবেল মেলে, কিন্তু আমার তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। কারণ এনারা আমার আত্মীয়।

    সাহিত্যিকেরা আত্মীয় হন। আমি যার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারি সে-ই আমার সাহিত্যিক। আমার চিত্তের স্বীকৃতি পাওয়া সাহিত্যিক। তিনি যিনিই হোন না কেন। উৎকর্ষতা বিচার করি এমন ক্ষমতা আমার কোথায়? অথবা অন্যের বিচারের মানদণ্ডে বিচার করে কোনো সাহিত্যকে মাথায় তুলে ঘুরি, বুকের মধ্যে সাড়া না পেলেও, এমন ছেলেমানুষী করার বয়েসই বা আর কোথায়?

    আমি জানি না কবিতারা এত কম সংখ্যায় নোবেল পায় কেন? তবে জানি সত্যিকারের কবিতারা জন্মায়ই এমন মর্যাদা নিয়ে তার জন্য আলাদা করে কোনো রাজতিলক আঁকা চাকুরেজীবীকে লাগে না। তার জন্য কোনো মঞ্চ বা শিরোপাও লাগে না। সে এক প্রাণ থেকে জন্মে আরেক প্রাণের অপেক্ষায় থাকে, যে তাকে গ্রহণ করবে তার প্রাণের উষ্ণতায়। সেখানেই সে সার্থক।

    কেউ যদি বলেন তুমি না লেখালেখি করো? তোমার এসব ইতরজনের মত কথা বলা সাজে? তুমি কৌলীন্যপ্রথা মেনে কথা বলো। আমার তবে উত্তর হল, মশায় আমি লিখি লেখার আনন্দে। এক, বাংলা অক্ষরগুলোর প্রতি ভালোবাসায়। দুই, বাংলা অক্ষরগুলোর উপর প্রতি আরো ভালোবাসায়। আর তিন হল একটা কথা বারবার বলতে যে তুমি যে-ই হও না কেন, কারোর দ্বারা পীড়িত বা শোষিত হওয়ার জন্য জন্মাওনি, এমনকি যদি ভিখারিও হয়ে থাকো - এই কথাটা বারবার মনে রাখার। স্বয়ং পরমেশ্বরও আমায় পীড়ন বা শোষণের যোগ্য মনে করেন না বলেই তিনি আমায় চরম দুঃখ সহ্য করার অধিকার দিয়েছেন, যাতে মিথ্যার গোলামিতে মান না খোয়াতে হয়। এই শক্তির কথাই আমার অপটু, অদক্ষ লেখায় বারবার বলে এসেছি। তাই নিজের জন্য প্রকাশক থেকে মঞ্চ কাউকেই আশা করি না। যাতে মানের আশায় সত্যের গলার স্বর গুলিয়ে না যায়। এই তো আমার কথা আমি বলতে পারছি, আপনারাও শুনতে পাচ্ছেন, আর কত?

    তবু যিনি নোবেল পেলেন এবং আগামীদিনে পাবেন সবার জন্যেই জানানো রইল আমার অভিনন্দন। আমার "রাই জাগো রাই জাগো" সুর গ্র‍্যামি না পাক, আমার 'মেঘে ঢাকা তারা' কি 'নির্জন সৈকতে' অস্কার না পাক, আমার 'আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে' র মত লাইন লিখতে পারা মানুষটা নোবেল পাক চাই না পাক, আমার কিচ্ছু আসে যায় না। এরা আমার আত্মীয়। আমার পরিবারের মানুষেরা যেমন স্বর্ণপদক না পাওয়া, জ্বর হলে মাথায় জলপট্টি দেওয়া আর পেট খারাপ হলে নুনচিনির জল গুলে দেওয়া পাশের লোক, এনারাও তাই। ব্যস, আর কি চাই?