Skip to main content

সত্যি বলতে ওর কথায় কিছু আসে যায় কি?
পাপোসের উপর বুড়ো আঙুলটা ঠেকাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে বিপ্লব। পা পাচ্ছে না। জুঁই খাটের এক কোণায় হেলান দিয়ে বসে। দেওয়ালে লোকনাথ বাবার ক্যালেণ্ডারটা পাখার হাওয়ায় বাঁদিক ডানদিক দুলছে।
বিপ্লব কিছু করে না। বত্রিশ বছর বয়েস। জুঁইয়ের ছত্রিশ। বাড়ি থেকে মানেনি। একটা ঘর ভাড়া করে থাকে। পায়খানা বাথরুম কমোন। জুঁই একটা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং এর কাজ করে। টিউশান পড়ায়। বিপ্লব সারাদিন পাড়ার মোড়ের ক্লাবে, না তো গাঁজার ঠেকে কাটিয়ে দেয়। জুঁই ডিভোর্সি। কোনো ইস্যু নেয়নি ওরা, নেবে না। 
বিপ্লব খিস্তি ছাড়া কথা বলে না। ওপরের কথাটা জুঁই বলল বিপ্লবকে, ওপরের বৌদি, মানে বাড়িওলি সম্পর্কে। সে বিপ্লবের ব্যাপারে খারাপ খারাপ কথা বলেছে। 
বিপ্লব ঠিক করল আজ সুইসাইড করবে। রোজই এই সন্ধ্যেবেলাটায় ভাবে। করে না। জুঁইয়ের নাইটির দিকে তাকালো। হাওয়ায় পায়ের কাছটা উড়ছে। নাইটি ছাড়া জুঁইকে মনে দেখল... কোনো ইচ্ছা হল না কিছু। আজ গঙ্গায় ঝাঁপ দেবে। পটলার বিড়ির দোকানটা একদম গঙ্গার গা ঘেঁষে। ওরও ওর বউয়ের সাথে হেভি ক্যাঁচাল। সে আবার নাকি অন্য পুরষের সাথে...থাক। সেদিকে মন দেবে না। একাই ঝাঁপ দেবে। 
বিপ্লব চিৎ হয়ে শুলো। মাথার উপর পাখাটা ঘুরছে। ব্লেডগুলো গোনা যাচ্ছে না। রাতে জুঁই ঘুমিয়ে পড়লে বিপ্লব যখন একা জেগে থাকে মাঝে মাঝে তখন শুধু পাখার ব্লেডের আওয়াজটা শোনা যায়। বিপ্লব চোখ বুজল। জুঁই নতুন একটা নেলপালিশ কিনেছে। সেটা লাগাচ্ছে। গন্ধটা পাচ্ছে বিপ্লব। সব নেলপালিশের গন্ধ এক। সব বেকারত্বের মত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিপ্লব। গলায় দড়ি দিতে পারে, দুপুরটা জুঁই বাড়ি থাকে না প্রায়ই। চোখ খুলল। পাখাটা হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। সম্মতি দিচ্ছে। বলছে ঝোল ঝোল ঝোল...আমি ধরে থাকব।
কি ভাবছ? 
জুঁই জিজ্ঞাসা করল। অন্যমনস্কভাবে। আগে গায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করত। এখন করে না। নাকি করে? বিপ্লবের মনে থাকে না? হতে পারে? 
বিপ্লব এক ঝটকায় উঠে টানটান দাঁড়িয়ে বলল, কিচ্ছু না... আসছি। 
বিপ্লব হাঁটছে। রাস্তাটা চেনা। তবু মানুষের মুডের সাথে সাথে সব কিছু চেঞ্জ হয়ে যায়। আজ বেশ হাল্কা লাগছে। এরা কেউ নয়। এই দুনিয়ার সে কেউ নয়। তারাও তার কেউ নয়... ইয়ে দুনিয়া... ইয়ে মেহেফিল... তার মোবাইলে গানটা আছে। সামনে গদাইয়ের মিষ্টির দোকান। শালা মাল খেয়ে বউটাকে পেটায়। কেউ কিছু বলে না, ও এখানকার বাজার কমিটির সেক্রেটারি। দোকানে রামকৃষ্ণ, চৈতন্য, লোকনাথবাবা, কালী, দূর্গা, শিব সব ফটো পর পর টাঙানো। বিপ্লব এখন ওদের দলে। ওরা মরে গেছে। সেও মরে যাবে একটু পর। জুঁই ওর ছবি ঘরে টাঙাবে। কদিন কাঁদবে। তারপর রোজ ধূপ দেবে। তার ফটোর উপরটা ধুলোয় কালো হবে। ফটোর সামনে ধূপের ছাই পড়তে পড়তে নোংরা হবে। তারপর একদিন জুঁই সব ভুলে যাবে। ওর বাপের বাড়ি চলে যাবে। 
টুনি গায়ে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, কিরে বাবা সামনে দিয়ে যাচ্ছিস চিনতে পারছিস না? ঠেকে যাবি না? 
টুনির বাজারে মাছের দোকান। বিশাল টাকা করেছে। পিছনে চুল্লুর ব্যবসাও আছে। ওর বউ পিয়ালী দেখে। টুনি আত্মহত্যা করবে না। লোকসান করলে করবে। সবাই আত্মহত্যা করতে পারে না। করতে চায় সবাই। কারণ থাকে, সাহস থাকে না। এগুলো ঠিক ভাবনা না। গদাইয়ের মিষ্টির দোকানের ছবির লোকেরা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বিপ্লব ভগবান মানে। তবে শালা বড্ড তেলখোর। মাল ছাড়ো কাজ হবে। বড়লোকদের তাই দীক্ষা হয়, সংঘ হয়। তাদের কেউ ডাকে না। 
বিপ্লব হঠাৎ কালী মন্দিরের দিকে এগোলো। মরার আগে মাকে প্রণাম করবে। শেষবার। মন্দির বন্ধ। অম্বুবাচী চলছে। বিপ্লবের কান্না পেলো। মায়ের মুখটা মনে পড়ল। মা বাবা ছোটো বয়সে চলে যায়। সংসারে এর ওর এঁটোকাটা খেয়ে মানুষ। নিজের বলতে কোনোকালে কেউ ছিল না। জুঁই এসে সব পাল্টে দিল। পাল্টে দিল না, এলোমেলো করে দিল। মাঝে মাঝে মনে হয় - করুণা করছে না তো? 
বিল্পবের রাগ হতে শুরু করল। করুণাটা সে ঠিক নিতে পারে না। গঙ্গার ধারে এসে বসল। পটলার বিড়ির দোকানটা এড়িয়ে এসেছে। যাক গে। এত কিছু ভাবার কি দরকার, এখনি তো সব শেষ। পায়ে গঙ্গার ঠাণ্ডা জল এসে লাগছে। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শিরশিরানি নামল। একটু একটু ভয় করছে। মনে মনে একবার গাঁজার গন্ধটা মনে করার চেষ্টা করল। হাওয়ার তার পায়জামাটা পতপত করে উড়ছে। তার মনটা হঠাৎ ভীষণ উদাস হতে শুরু করল। জুঁইয়ের নাইটির উড়ে উড়ে খাটের চাদরের উপরে আছড়ে পড়া... তাদের ঘরের গন্ধ... জুইয়ের চুমু... আদর... ওর ঘর্মাক্ত শরীরে পড়িয়ে ফেরা... পিঠের দিকে জামায় মানে কামিজে ঘামের ছাপ...
সে কেন কিছু করে না? বিশুদা তো সেদিনও বলল ওদের হার্ডওয়ারের দোকানের গোডাউনে কাজটা এখনও ফাঁকা আছে। বেকার মরে কি হবে? সে করবে কাজটা।


বিপ্লব... বিপ্লব...
টুনি ছুটতে ছুটতে হাঁপাতে হাঁপাতে এলো...
শালা এখানে বসে তুই... আর আমি সারা বাজার ঠেক... শিগ্‌গীরি চ... বৌদি অ্যাসিড খেয়েছে... কিছু ক্যাঁচাল হয়েছিল আজ?...