Skip to main content

কল্যাণী স্টেশান চত্বরে বেশ কয়েকটা নার্সিংহোম। কোনোটায় খরচ বেশি, কোনোটায় অপেক্ষাকৃত কম। এক বন্ধুর সঙ্গে গেছি। বিকেলবেলা, ভিজিটিং আওয়ারে। অসুস্থ মানুষটার সঙ্গে অল্প কিছু কথা বলে বন্ধুর সঙ্গে বাইরে এসেছি ওষুধের দোকানে। কয়েকটা ওষুধ কিনে দিয়ে আসতে হবে।

বন্ধু ওষুধ কিনছে। আমি রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে মোবাইল ঘাঁটছি, হঠাৎ মনে হল খুব ধীরে কেউ আমার নাম ধরে ডাকল। পাশে তাকিয়ে দেখি, বলাইকাকা। ভ্যান চালাতো। বহু বছর আগে শেষ দেখেছি। মানুষের মুখ মনে রাখার মস্তিষ্কের একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে। যাকে মনে রাখে, তার মুখের গড়নের এমন কিছু, এমনভাবে মনে রাখে যে হঠাৎ চিনতে পারলে নিজেরই অবাক লাগে…. এ মানুষটা এতদিন ধরে আমার স্মৃতিতে ছিল…. অথচ আমিই জানতাম না! গানের ক্ষেত্রেও হয় দেখেছি, কত বছর আগে শোনা গান… হঠাৎ কিভাবে কোনো উদ্দীপনায় গোটাটা সামনে এসে দাঁড়ায়! ভাবতেই অবাক লাগে সে গানের প্রতিটা লাইন, প্রতিটা শব্দ এত গভীর স্মৃতিতে ছিল!

যা হোক, দীর্ঘদিনের ব্যবধান, তায় সামাজিক বৈষম্যের কারণে কাকার 'কিন্তু কিন্তু' লাগছিল ডাকতে। এখনও লাগছে। যাকে ডাকছে তার চুলেও পাক ধরেছে। তার ব্যক্তিত্বেও বয়সের সর জমেছে।

আমি বললাম, তুমি এখানে কেন গো… সব ঠিক আছে তো?

কথার সূত্র পেতে সহজ হল, কারণ বলাইকাকার হাতে ধরা প্রেসক্রিপশন আর ওষুধের প্লাস্টিক দেখে। আসলে কিছু কিছু জায়গায় বহুদিনের আড়ষ্টতা আপনিই কেটে কথা সহজে এগিয়ে যায় দেখেছি। তার মধ্যে হাস্পাতাল, নার্সিংহোম তো আছেই।

বলাই কাকা একগাল হেসে বলল, টুনির ছেলে হয়েছে গো…. ছোটো মেয়ে আমার…. মনে আছে?

নিজের স্মৃতির কাছে নিজেই আবার অবাক হলাম। খুব রুগ্ন একটা মেয়ে, তার মায়ের সঙ্গে আমাদের আগের বাড়ির রান্নাঘরের সামনে বসে আছে দেখতে পেলাম। আবছা।

বলালাম, ওহ, হ্যাঁ… কাকিমাও এসেছেন?….

সুর কাটল। বলাইকাকার নীচের ঠোঁটটা কেঁপে, চোখ মুহূর্তে জলে ভরে গেল। যেমন হঠাৎ বৃষ্টিতে আনাচে-কানাচেতে পড়ে থাকা ভাঙা টব, বাটি, বোতলের ছিপি জলে ভরে যায়।

বলল, করুণায় (করোনায়) চলে গেল তো….

এ শোক ছাপানো অভিমান। যতদিন যায় এ অভিমানে পাকা রঙ পড়ে। একে নাড়াচাড়া করতে নেই বেশি। ওতে ব্যথাই বাড়ে। বললাম, চলো তোমার নাতি দেখে আসি…. এখনও সময় আছে তো… হাতে ধরা মোবাইলে সময় দেখলাম। তার দরকার ছিল না, কারণ বাইরের আলোই বলে দিচ্ছিল সময় আছে….কিন্তু চোখটা সরানোর দরকার ছিল। তাই।

========

দোতলায়, কি তিনতলায় উঠলাম। চারদিক দেখতে দেখতে উঠছিলাম। এ নার্সিংহোমে আগে আসা হয়নি। আসলে আমাদের যাতায়াতের পরিখা তো সমাজ নিজের নিয়মে কেটেই দেয় না! কোথাও কোথাও তাই আমাদের আসা যাওয়াটা 'বেমানান' হয়ে যায়। এই যেমন এখন যেখানে।

টুনিকে আমি চিনতে পারলাম না। টুনিও পারল না। সে লজ্জা পেল। আমি অস্বস্তিতে পড়লাম। এইবার করণীয় কি? টুনির কোলে ওর বাচ্চা। কাপড়ে জড়ানো। খুব সম্ভবত ঘুমাচ্ছে।

দু-একটা সাধারণ কথা বললাম। স্ক্রিপ্টের মত। শরীর কেমন? খাওয়াদাওয়া করছে কিনা। শ্বশুরবাড়ি কোথায়? বর কি করে ইত্যাদি।

হঠাৎ একজন মহিলা এগিয়ে এলেন। পোশাকে বুঝলাম মুসলমান। এসে কাউকে কিছু না বলে বাচ্চাটাকে নিয়ে, "ওরে আমার বাবুটা…"... এইসব বলতে বলতে চলে গেলেন।

আমার বিস্ময় বলাইকাকার চোখে পড়ল। এড়িয়ে গেল। আমিও কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। বললাম, যাই চলো… আরেকবার ওই নার্সিংহোমে যেতে হবে।

টুনির কাছ থেকেও বিদায় নিয়ে বলাইকাকার সঙ্গে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। মনের মধ্যে প্রশ্নটা। ওই মুসলিম মহিলাটি কে?

বলাইকাকা বলল, তুমি যাকে দেখলে, ওই বাবুকে নিয়ে গেল…. ওর বুকেরই দুধ খাচ্ছে বাবু… আমার মেয়েটার এখনও আসেনি….

মানুষের মন কি বিচিত্র। এতক্ষণ বলাইকাকার গলায় পরা কণ্ঠির দিকে নজর পড়েনি। এখন পড়ল।

বলাইকাকা বলল, মায়ের আবার জাত কি বলো…. ভগবান বলো… আল্লাহ বলো…. মানুষেরই দেওয়া নাম…. ডাকে তো একজনকেই… আমার বাবুটার খাবার ওর কাছেই পাঠিয়েছে ভগবান…. তাঁর লীলা আমরা কি বুঝি বলো.. খাক খাক….. ওতে কিছু হয় না… হয় বলো?

সন্ধ্যে হয়ে আসছে। রাস্তার পাশে বড় বড় গাছগুলোয় পাখিরা ফিরছে। তাদের কিচিরমিচির ছাপিয়ে রাস্তার গাড়ির হর্ন, মানুষের চীৎকার চেঁচামেচি…  তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার সামনে একজন নিরক্ষর মানুষ কি সহজে, কি গভীর কথা বলছে!

মানুষের মনে একটা সরলতার তত্ত্ব থাকে। সহজতত্ত্ব। সে বুঝতে পুঁথিগত বিদ্যাবুদ্ধির চাইতে জন্মগত সহজ বুদ্ধি লাগে। বলাইকাকার বুদ্ধিতে সেই বুদ্ধির তান। বুঝতে যুক্তি লাগে না।

বলাইকাকার থেকে বিদায় নিয়ে ফিরব। বলাইকাকার গলার কণ্ঠি, ওই মহিলার পোশাক তাদের নিজেদের নিজস্ব আস্থার পরিচয়। সে বৈচিত্র্যময়। বিরোধ তো নয়!... বিরোধে কাদের স্বার্থ?!

বলাইকাকার হাতে কিছু দিয়ে বললাম, ভাবো মা দিলেন…. মায়ের তো কোনো জাত, পরিচয়, আমার তোমার.. হয় না বলো…. তুমিই বললে, এটা রাখো…..

বলাইকাকা হাতটা ধরে বলল, তোমার মা…. বউদির কাছে এতকিছু…..

ব্যস। আর না। এবার আমার এগোতে হবে। আমারও পাকা রঙের ঘর আছে। অভিমানের ঘর। সেখানে বেশি নাড়াচাড়া করতে নেই। ব্যথা লাগে।