Skip to main content

জয়রামবাটিতে বসন্ত এসেছে। সারদা দাঁড়িয়ে একটা পলাশ গাছের সামনে। কোকিল একটা ডেকেই যাচ্ছে কখন থেকে, যেন বলছে... মা... মা... মা।

সারদা কান পাতলেই শোনেন মা ডাক। পাখির ডাক, আমোদর নদীতে জলের কুলকুল শব্দ, কামারপুকুরের হালদার পুকুরে বর্ষায় জল পড়ার শব্দ... এমনকি গরুটা, ছাগলটা ডেকে উঠলেও শোনেন মা ডাক। ঠাকুরের ছবির দিকে তাকালেও মনে হয় ঠাকুর ডাকছেন, মা। তিনি সারদা থেকে আজ মা সারদা।

ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। আমোদরের এদিকটা ফাঁকা আজ। মা সারদা বসে আছেন। নদী তার দিকে উছল হয়ে তাকাতে তাকাতে বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ পিছন দিক থেকে কেউ ডাকল.... মা...

মা পিছন ফিরে তাকালেন। সূর্য মধ্যগগনে, এক যুবক দাঁড়িয়ে, তার মুখটা সূর্যের ছটায় আরো যেন আলো আলো। মা বললেন, তুমি কে বাবা?

সে পাশে এসে বসল। মা মুখের দিকে তাকালেন। চোখদুটো যেন বৃন্দাবনের মাটিতে মাখা, এত গভীর চোখ! ঠোঁটের উপর যেন পারিজাতের পালক বুলালেও কেটে রক্ত বেরোবে, এমন কোমল ঠোঁট।

সে বলল, আমি কাশী থেকে আসছি মা, আমার নাম কবীর... আমি জোলা।

মা তাকালেন চোখের দিকে। তিনি হেসে বললেন, আমি চিনেছি তোমায়। তুমি রত্নাকর, মাণিক্য পেয়েছ। গান বেঁধেছ। পদের মধ্যে আলোর স্ফুলিঙ্গ জ্বেলেছ। বলো, মায়ের কাছে কেন?

কবীর বলল, মা মানুষের সব চাইতে ভালো অবস্থা তো সহজাবস্থা?

মা বললেন, তাই তো বাবা। মানুষ যখন সহজ হয়ে থাকে তখন সে সবটা বোঝে, অনুভব করে। তার সহজাবস্থা টলে গেলেই তো সে ক্ষেপে। আমার কাছে এক যুবক আসত, থেকে থেকেই বলতো ঠাকুরকে দেখিয়ে দাও... আচ্ছা বাবা, ঠাকুর কি লাউকুমড়ো যে ক্ষেত থেকে তুলে দেখিয়ে দেব? মানুষ সহজ হলে সে সহজ মানুষকে চেনা যায়। ঠাকুর গাইতেন।

কবীর বলল, আমি সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াই সহজ মানুষের সঙ্গ করব বলে, তোমার মত সহজ মা আমি জগতে দুটো দেখলাম না....

মা বললেন, তুমি নিজে সহজ বলেই বাবা আমাকে চিনেছ.... নইলে আমাকে নিয়ে কত মানুষের কত ভাব.... কিন্তু সে সব অনিত্য... ঠাকুর যেমন বলতেন ভক্ত আগে দশ হাত দেখে, শেষে গোপাল.... দুই হাত....

কবীর বললেন, মা এই সহজাবস্থা আগের কথা, না শেষের?

মা বললেন, দেখো বাবা, মানুষের মনে যত বিকার তার রাস্তা ততটাই, তোমার গানে আছে না, আমাকে কোথায় আর খুঁজছ... আমি না মন্দিরে, না মসজিদে... আমি তোর কাছেই আছি তোর বিশ্বাসে..... এই হল কথা বাবা.... বিকার কাটলেই সহজ হয় মানুষ.... তখন তার আড়ম্বর, সাজসজ্জা রকমসকম সব ভেসে যায়, আলুনি লাগে.... সে দেখে সহজ হয়ে থাকলেই আনন্দ.... সহজতাতেই সত্য.... সুখ.... পরমার্থ.....

কবীর বলল, আমিও গানে, জীবনে এই কথাটাই বলতে চাই মা.... কিন্তু মানুষের মনে এত বিদ্বেষ... ভেদভাব.....

মা বললেন, জানি বাবা, তুমি সহজ থাকতে চাইলেই জগত তোমায় অস্থির করে তুলবে.... তোমায় আস্তরকমে না ক্ষেপালে জগতের শান্তি নেই.... নইলে সংসারে দেখো না, যা নিয়ে মানুষের অশান্তির শেষ নেই, আবার তাই নিয়ে তার গর্বেরও শেষ নেই.....

তাই মা, তাই দেখি, মিথ্যা বললে জগত খুশী, আর সত্য বললে জগত মারতে আসে, কবীর বলল।

মা বললেন, এই তো মোহ বাবা। সহজকে জটিল বানিয়ে নিজের চারদিকে চরকির মত ঘোরা..... এর থেকে বেরোতে পারে আর কজন?

মা আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন?

একজন দাঁড়িয়ে। কলকাতা থেকে এসেছে। মায়ের চেনা। মা হেসে বললেন, ও কিছু নয় বাবা..... এমনিই.... চলো.... রাধু কি বাগানের দিকে একবার দেখে যাই চলো.... তোমার রাস্তায় আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

মা চলে গেলেন। পলাশের গাছের নীচে কয়েকটা পলাশ ঝরে পড়ল। দুটো বৃত্ত হল। দুই বৃত্তের পরিধি মিলিয়ে গেল, কেন্দ্রে জেগে রইল একটা করে পলাশ, রক্তিম উষ্ণ হৃদয়ের মত। কোকিল ডেকে উঠল, আকাশ বাতাস শুনল.... মা। জগতের সহজতম ডাক।