যার রান্নাঘরে, শোয়ার ঘরে কখনও সূর্যের আলো পৌঁছায় না, সেই মধ্যবয়সী মহিলা বসে চেয়ারে, সমুদ্রের ধারে। সারা চোখ হোটেলের ঘরে ঘুমের ক্লান্তিতে বিষণ্ণ। এতবড় একটা সমুদ্র, কি করবে একে নিয়ে? কি দেখবে? কি বুঝবে? নোনা হাওয়ায় গাল, কপাল, হাত চটচট করছে। চায়ের স্বাদ বাড়ির মত নয়। এতবড় অবসর কি করবে? ছেলেমেয়ে বাবার সঙ্গে খেলছে। সবাই অন্য মানুষ। সবাই জানে ছুটি পেলে কি করতে হয়। কিন্তু আমি তো জানি না। একটা ঝাঁটা পেলে এই সমুদ্রতট ঝাঁট দিয়ে নিই। ঠাকুরঘর পেলে স্নান সেরে ফুল সাজিয়ে প্রদীপ জ্বেলে বসি। কিন্তু জগন্নাথ? সেখানে তো প্রচুর ভিড়। আমার কি করার আছে সেখানে? কি চাওয়ার আছে?
সারা গা-হাত-পা ব্যথা। নড়তে ইচ্ছা করছে না। সমুদ্রে ঢেউয়ের পর ঢেউ। আসছে যাচ্ছে। এত ছুটি, এত আরাম! তাও রান্না করে খাবে না। হোটেলে খাওয়া হবে। আবার দুপুরে ঘুম। আবার বিকেলে সমুদ্র। আবার কাল বাসে চড়ে নন্দনকানন, ধবলগিরি..... এর চাইতে যদি নির্জন পাহাড়ের কোল হত... যদি নিরিবিলি বাপের বাড়ির উঠান হত.... যদি মামাবাড়ির জয়পুরের জঙ্গল হত..... এত ভিড় কেন? এত উল্লাস কেন? এত চীৎকার কেন? হা ঈশ্বর!
======
মিষ্টি কিনে দু'জনে বসে পাশাপাশি। দু'জনেই মধ্যবয়সে বিধবা। ট্রেনে যেতে আলাপ। পাশাপাশি গ্রামে থাকে নদীয়ায়। অথচ আলাপ হল শিয়ালদায়। কলকাতায় সামান্য কাজ করে।
দু'জনে বালিতে বসে। সামনে সমুদ্র। দিগন্তের উপর জুড়ে মেঘ। মাথা অবধি। দু'জনেই স্তব্ধ। কান্না নেই। শোক নেই। স্বপ্ন নেই। বিস্ময় নেই। কিছু দীর্ঘশ্বাস আছে। কালো কালি পড়া চোখের উপর এমন বিশাল সমুদ্র বারবার বর্ণমালা লিখছে, মুছে ফেলছে। একটা বাক্যও লিখতে পারছে না ঠিকঠাক। জগন্নাথদেবও পারেনি। অমন বড় বড় দুটো চোখ নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, কি চাই? তারা দু'জনে হাত ধরাধরি করে ভিড়ে ধাক্কা খেতে খেতে বলেছে, একটু ভরসা। জীবন মানে কি? কিছু যে একটা, তার ভরসা। ভরসা না থাকলে বুদ্ধিশুদ্ধি কি? আর শান্তিই বা কোথায়?
জগন্নাথদেব মালপো পাঠিয়েছে, মহাপ্রসাদ পাঠিয়েছে পাণ্ডার হাতে। তারা দু'জনে সস্তার হোটেল রুমে বসে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে ভরসা। পায়নি।
======
একটা চোখ নষ্ট। বয়েস পঞ্চান্ন পেরিয়েছে। শরীরে মেদ জমেনি। টি-শার্ট আর জিন্স পরে থাকা পুরুষমানুষটা লুটিয়ে হরিদাসের সমাধি মন্দিরে। কীর্তন চলছে। কীর্তনের তালে তালে কান্না উঠছে। সংসারে কর্তব্যের ঢেউ পেরিয়ে পেরিয়ে এসে যে দ্বীপে এসে আশ্রয় পেয়েছে, সে দ্বীপে মানুষ নেই। স্ত্রী চলে গেল। মেয়ে বাইরে থাকে। ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে এসেছিল এই মন্দিরে। তারপর সব মিথ্যা মনে হয়েছিল। যে সুখের জোরে ঈশ্বর মিথ্যা হয়েছিল, সে সুখের নগর গেল উড়ে, এক ঝড়ে। পড়ে রইল ভাঙা মন্দির। বাবার হাতের স্মৃতি। গায়ের গন্ধ। বাবাকে খুঁজতে আবার আসা এই মন্দিরে। বাবার কাছে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। মদ ছোঁবে না। নিরামিষ হবে আহার। বাবাকে খুঁজছে। কি করে পেরেছিলে তুমি? আমি তো পারছি না? আমার মা-ও তো চলে গিয়েছিল। আমায় নিয়ে তুমি লড়েছিলে একা। তোমার জপের মালা, তোমার কীর্তনের দল, তোমার সাশ্রুনয়নে জগন্নাথ বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে থাকা। আমিও খুঁজতে এসেছি। আমি নকল করছি তোমায়? না, খুঁজছি তোমায়? তুমি কি শুনছ?
হরির লুটের বাতাসা পড়ল কপালে। উঠে বাতাসা পুরল মুখে। চিবাতে ইচ্ছা করল না। থাক্, ধীরে ধীরে গলুক।
বাতাসা মুখে গলি পেরিয়ে এসে বসল সমুদ্রের ধারে। বাবা, শুনছ? বাতাসা গলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ঢেউয়ের আছড়ে পরা আওয়াজে বাবা বলছে, চটিটা খোল প্রশান্ত.... জলে নাম.... ভিজে যা....
======
জলে নামার কথা ছিল না। তবু নেমেছে। সমুদ্র ডেকেছে বলেই নেমেছে। দুই হাতে পেশীর জোরে তছনছ করেছে তার গোটা শরীর। দুমড়ে মুচড়ে ভেঙেছে। ঢেউয়ের আছিলায় প্রবেশ করেছে তার ভিতরে। নিজেকে সমর্পণ করেছে সে।
এখন সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে শাড়ি শুকাচ্ছে পানকৌড়ির মত। তার ক্ষীণ শরীরের ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা জলের বিন্দু শুষে নিচ্ছা বাতাস। অসভ্য, বেহায়ার মত। কত যে চোখ চারদিকে। বরাদ্দ দুঃখের থেকে বেশি দুঃখ পেলে মানুষে বলে, ও ভাগ্য.... ঈশ্বরের ইচ্ছা..... বরাদ্দ সুখের থেকে বেশি পেলে মানুষে বলে, বেহায়া.....
সে শুধু নয়, তার মত অনেক বেহায়া এসেছে পুরী। যারা যৌবন বেচে পেট চালায়, মানুষী শখ পূরণ করে... যতটা নাগালে পায়...
কাল গিয়েছিল মন্দিরে। সবাই। চীৎকার করে বলেছে, জয় জগন্নাথ!
শুভদ্রার চোখে চোখ পড়েছে সবার। শুভদ্রা বলতে চেয়েছে কিছু.... পারেনি। দুই ভাইয়ের পাশে বসে বলেছে, পরে আসিস একা.... শুনব... আমারও বলার আছে কিছু।
======
গোবর্ধন মঠে বসে সন্ন্যাসী। শঙ্করাচার্যের প্রতিষ্ঠিত অর্ধনারীশ্বর মূর্তি, গোবিন্দের মূর্তি দেখছে। গরুড় আর নন্দীর এমন যুগ্ম মূর্তি দেখেনি কোথাও। তার নিজের অস্তিত্বেও অর্ধনারীশ্বরের উপস্থিতি। কিন্তু সে তো পাথর নয়। সে অর্ধনারীশ্বর, রক্তে মাংসে। সব ত্যাগ করেছে। আজকাল তো নবীন সন্ন্যাসীদের পাঠও দিতে হয় উপনিষদ, গীতার। এখানকার শঙ্করাচার্যের সঙ্গে আলাপ হল। সব ভালো হচ্ছে, কিন্তু শুষ্কতা যাচ্ছে না। সব যেন ব্যর্থ হচ্ছে।
মঠ থেকে মাঝরাতে এলো সমুদ্রের তীরে। দেখতে দেখতে ভোর হল। প্রাণের শূন্যতার হাহাকার সমুদ্রের গর্জনকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। কি হল? কি করল আজীবন? গোটা সংসার কি মায়া নয়? এ শরীর, এ বাসনা-কামনা জর্জরিত মন-বুদ্ধি-চিত্ত... সব ভ্রম। একমাত্র সত্য আত্মা। তবে এ পীড়া কেন? তবে কি এ জীবন ব্যর্থ হবে? শুধু মনের গভীরে সে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে বলে? নিজেকে সরিয়ে নিজেকে পাওয়া যায় কি?
সন্ন্যাসীর কি যেন মনে পড়ল। বৈষ্ণব মঠে ঢুকল। কি এক লেখা দেখেছে গতকাল.... এদিকে এসেছিল মাধুকরী করতে.... কি যেন লেখা ছিল..... মনে পড়ল... "জীব নিত্য কৃষ্ণদাস যবে ভুলি গেলা"......
সন্ন্যাসী, গৃহী, শরীর, বাসনা.... কি সব শব্দের ঘোরে পড়েছিল সে! শব্দজাল মহারণ্যের মত.... শঙ্করকে মনে পড়ল...
সেদিন সন্ধ্যাতে যখন সে মন্দিরে এলো। তার গায়ে গেরুয়া নেই। সাদা বস্ত্র। জগন্নাথকে প্রণাম করে মহাপ্রভুর পদচিহ্নের কাছে এসে বসল। কানে এলো সমুদ্রের গর্জন। কানে না, প্রাণে এলো। বিশাল তোড় আসছে। সব ভেঙে যাবে। যাক্...
======
দুটো বাচ্চার হুটোপুটি সামলিয়ে বাবা একজনকে কাঁধে, একজনকে কোলে নিয়ে বালির তীরে উঠল। পিছনে শাড়ি নিংড়ে মা। হাঁটছে রাস্তার দিকে। ভোর হল কিছুক্ষণ হল। এক বৃদ্ধা আর এক সন্ন্যাসী পাশাপাশি বসে। তারা হেসে বলল, জয় জগন্নাথ। সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করল, স্নান হল?
বাবা বলল, হল। আজ ফেরার ট্রেন।
বৃদ্ধা বলল, প্রভু দর্শন হল?
মা বলল, হল।
======
রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাথ। ফুটপাথ পেরিয়ে বালি। তারপর সমুদ্র।
বৃদ্ধা হাওয়াই চটিটাকে পায়ের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে বালির উপর দিয়ে হাঁটছে। চটি বসে যাচ্ছে, আবার জেদের সঙ্গে তুলে পরের পা ফেলছে বালিতে। সামনে সমুদ্র। সব প্রভুর সৃষ্টি। প্রভু মন্দিরে। জগন্নাথ। চোখে দেখে না। ঝাপসা চোখে প্রভুর হাত ভরসা। ছাড়েনি প্রভু। সে নিজে ছেড়েছে। পড়েছে। আবার হাত ধরেছে। এই তো প্রভুর হাত। এই তো ডাক।