ছাদে চুপ করে বসে সৃজিত নন্দী। বুকে ব্যাথা, হাতে পায়ে ব্যথা, মাথায় ব্যাথা। নাঃ, আসলে মনটায় ব্যাথা। সবাই এগোচ্ছে একই গর্তের এদিক থেকে ওদিক। এদিকে ঠেক খেয়ে ওদিক। আবার ওদিকে ঠেক খেয়ে এদিক। এই মধ্য বয়সে এসেও কোনো কূল কিনারা হল না। এ জীবনে কি এমন আছে যাঁর জন্য এতকিছু গোছাতে হল। মৃত্যু সারাক্ষণ কাকের মত মাথার উপর মগডালটায় বসে আছে। সুযোগ পেলেই ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে। ভাল্লাগে না আর বাঁচতে, ধুর!
সৃজিতবাবু উঠে পায়চারী করতে লাগলেন ছাদে। বরানগরের এই বাড়িটা তাঁর ঠাকুরদার। এখন বাড়িতে তিনি আর গিন্নী। এক ছেলে হায়দ্রাবাদে আর একজন সল্টলেকে ফ্ল্যাটে।
এখন একটা কথাই মনে হয়, এ পরবাসে রবে কে। সত্যিই কি খাঁটি কথা। কত ঠকলেন সারা জীবন। কাউকে দোষ দিয়ে কি লাভ। কে আর স্বাধীন, নিজের স্বভাবের কাছে। কত চাহিদা, কত ক্ষোভ, কত লোভ চারদিকে। এর মাঝে কাকে, কি কথা, কখন দেওয়া হয়েছিল, তা মনে থাকে? আর রাখার দরকারই বা কি? অত চাপ কে নেয়! বয়ে চলো, বয়ে চলো। খড় কুঁটোর মত।
-চা খাবে না? মালতী দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ নিয়ে। সৃজিতবাবু চমকে তাকালেন। মালতী অনেকদিন চুলে রঙ লাগায় নি। সাদা চুল গুলো বসন্তের হাওয়ায় উড়ছে কয়েকটা।
তিনি চায়ের কাপটা মালতীর হাত থেকে নিয়ে বললেন, বোসো না একটু।
মালতীদেবী বসলেন।
-আচ্ছা, তোমার কোনো ক্ষোভ নেই? এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, পাগলের মত লাগে না তোমার? এত ভাল স্কুলে পড়াও। কটা ছেলেমেয়েকে আজ আবধি ঠিক ঠাক মানুষ গড়তে পেরেছ? নিজের গুলোকেই কি আমরা পারলাম মানুষ করতে? মালতী, আমরা পুরো ব্যর্থ হলাম, পুরোপুরি ফেইল ইওর! কিস্যু করতে পারলাম না। তোমার ক্ষোভ হয় না?
- জানি না, চিনি ঠিক আছে?
- আছে, ওসব কথা ছাড় না! তুমি বলো না। এত হানাহানি, হিংসা, ধর্ষন, দূর্নীতি, আমরা কিচ্ছু করতে পারি না? আমরা শুধুই দর্শক মালতী? তোমার আমার কোনো দায়িত্ব নেই। তুমি স্কুলে আর আমি কলেজে সারাটা জীবন কাটালাম। প্রচুর অর্থ, সম্মান, উপার্জন করলাম। আমাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই? শুধু ফাঁপা কটা কথা আওড়িয়ে গেলাম যে গো সারাজীবন।
-এত উতলা হোয়ো না। প্রসুনের ওখানে যাবে? (ছোট ছেলে, যে সল্টলেকে থাকে)
-না। সেই কর্পোরেট রুল বাড়িতে। অসহ্য। মেয়েটাকে পর্য্যন্ত রোবোটের মত বানিয়ে ছাড়ছে তোমার ছোট বৌ।
-দেখো প্রাচী দিল্লীতে মানুষ। ওর ধ্যান-ধারণা তো আলাদা হবেই।
মালতীদেবী খেয়াল করলেন, সৃজিত অন্যমনস্ক হয়ে সামনের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছেন, কি ভাবছ?
-আচ্ছা এই যে ও বাড়ির রঞ্জনদা গত মাসে গলায় দড়ি দিল। কি আশ্চর্য। কিছু টের পেলাম না আমরা, যে আমার পাশের মানুষটাই, যার সাথে দুবেলা দেখা হচ্ছে, সে বেঁচে থাকার সব কারণ হারিয়ে বসে আছে? কি স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি আমরা, মালতী!
-শোনো আমার মনে হয় আমাদের একটু বেরোনো দরকার। তুমি রতনকে (ড্রাইভার) আসতে বলে দাও, চলো বেলুড়মঠে ঘুরে আসি। অনেকদিন যাই নি। আমি রেডি হচ্ছি, তুমি এসো বুঝলে।
-দেখছি
-না দেখছি টেখছি না, এসব ভেবে প্রেশার বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি নামলাম। এসো বুঝলে।
মালতীদেবী চলে গেলেন।
সৃজিতবাবু পশ্চিমকাশে তাকিয়ে। ডুবন্ত সূর্য্য। ঘরে ফেরা পাখির দল। দূরে কারখানার চিমনির ধোঁয়া। সৃজিতবাবুর কান্না পাচ্ছে। নীচে তাকালেন। কত মানুষ। কতরকম অনুভূতি মুখগুলোর প্রতিটা রেখায়। তিনি যেন দিব্য দৃষ্টি পেয়েছেন। এত ছুটোছুটি কোথায় পৌঁছানোর জন্য? আদৌ কি কোথাও পোঁছায় মানুষ?
২
-------
গাড়ির কাঁচের ভিতর দিয়ে আসন্ন সন্ধ্যাকে কলকাতার বুকে দেখছেন। চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। আচ্ছা আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগে কেমন ছিল এই সব জায়গা? ঘন জঙ্গল। তাতে আদিম মানুষ। চারিদিকে বন্য জীব।
গাড়িটা ট্র্যাফিকে আটকে। চারিদিকে মানুষ আর মানুষ। কেন এত নিরুত্তাপ সব? যেন কিছুই ঘটছে না কোথাও। কিসের এ নিরুত্তাপ?
রাস্তার ও ফুটে শাড়ীর দোকানে চোখ পড়ল তাঁর। কি নিশ্চিন্তে হাসি মুখে শাড়ি দেখিয়ে চলেছে লোকটা, সামনে বসা দুজন মহিলাকে। যেন কিছুই ক্ষোভ নেই তার নিজের জীবন নিয়ে, কি চারপাশ নিয়ে। কেন হবে এরকম! তাঁর কিরকম অস্থির লাগতে লাগল হঠাৎ। তিনি গাড়ির দরজা খুলে সটান রাস্তায় নেমে পড়লেন। ওই ফুটে যেতে হবে তাঁকে। ওকে জিজ্ঞাসা করতেই হবে, কেন এত নিশ্চিন্ত সে? চারিদিকে থিক থিক করছে গাড়ি। সিগন্যাল সবুজ হয়ে গেল। মালতী দেবী, কি হল গো, নামলে কেন? আরে সিগন্যাল হয়ে গেছে...বলতে বলতে তিনিও নেমে পড়লেন। সৃজিতবাবু রাস্তা পার করে চলেছেন কিসের ঘোরে যেন একটা। জানেন যে কোনো মুহুর্তেই একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তবু!
দোকানে এসে দাঁড়ালেন। লোকটা মাথা তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন।
সৃজিতবাবু লোকটার চোখের দিকে তাকালেন। কি একটা হল তাঁর। তিনি যেন সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের সন্ধিক্ষণ থেকে আজ অবধি, যুগ যুগ ধরে মানুষের এগিয়ে চলার ইতিহাসকে এই দুটো চোখে দেখে ফেললেন। সব মানুষের প্রতিনিধি হয়ে বসে, তার সামনে এক নাম না জানা শাড়ী বিক্রেতা। সে বাঁচতে চায়। বাঁচার ব্যাখা চায় না, উদ্দেশ্য চায় না। শুধু বাঁচতে, আপ্রাণ বাঁচতে চায়। কত সীমিত ক্ষমতা, আর ক্ষুদ্র সময়ের গণ্ডীতে সে বাধা। অথচ তার সামনে, পিছনে, ডাঁয়ে, বাঁয়ে অযুত-নিযুত সমস্যা। তবু এ অসম লড়াই করেই সে বাঁচতে চায়।
তাঁর চোখে জল এল। সত্যিই মানুষ সুখী তার অজ্ঞতায়, ভুলে যাওয়ায়, মেনে নেওয়ায়। তাই জীবনকে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেই সে বাঁচতে চায়, সব হারাতে পারে এক লহমায় জেনেও। তিনি হঠাৎ করে মানুষটাকে ভালোবেসে ফেললেন। তাঁর গলার স্বর পালটে গেল। এ মানুষটা যেন খুব পরিচিত তাঁর। বাইরে তাকালেন। মানুষের মিছিল না, মানুষের মহাসমুদ্র! তিনি কি করে যেন দূরে সরে গিয়েছিলেন সব কিছু থেকে। সমস্যাগুলো খুব ক্ষুদ্র হয়ে গেল, মাথাটা হাল্কা লাগতে শুরু করেছে, জীবনটা স্পষ্ট না হোক তাঁর কাছে, জীবনকে ভালোবাসার আকূতিটা খুব স্পষ্ট। সেটাই সব।
তিনি বললেন, তাঁতের শাড়ি দেখাবেন।
মালতীর দিকে তাকালেন। সে হতবাক হয়ে তাকিয়ে তাঁর মুখের দিকে। ফ্যাকাসে মুখে ছলছল দুটো চোখ। বললেন, তুমি পারোও!