বাঁ হাতের গোড়া থেকে টাটাচ্ছিল। এই হাতের কাঁধের কাছে গোলাটা দুবার বেরিয়ে গিয়েছিল ধড় থেকে। কি যন্ত্রণা, উফ্..., কি যন্ত্রণা খাণ্ডোবাই জানে। আবার খাণ্ডোবার নাম করছে! মন বড় পাজি। কয়লার মত। যতই ধোও রঙ আর যায় না।
মহারাষ্ট্রের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম।
অম্বেগাঁও থেকে আরো ভিতরে। বর্ষাকালে চটি খুলে হাঁটতে হয়। সুরজ হাতটা লম্বা করে বসে,
চন্দা তেল গরম করে মালিশ করছে। সুরজ বলল, তুই খান্ডোবা, মারুতির মূর্তি রেখেছিস কেন?
জানিস না আমাদের ভগবান ভীমরাও আর বুদ্ধ?
চন্দা জানে সুরজ খাণ্ডোবাকে খুব মানে।
সে বার জ্বরে জলপট্টি লাগাবার সময় চন্দা শুনেছে, জ্বরের ঘোরে সুরজ বলছে, মাথাটা ছিঁড়ে
যাচ্ছে খাণ্ডোবা... মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে….
সুরজ দেখল চন্দা উত্তর করল না। যতীন
ঘুমাচ্ছে, তাদের ছেলে, পাঁচ বছর হবে, এই সামনের এগারো তারিখে।
সুরজ বলল, কিরে বল, কেন রেখেছিস খাণ্ডোবা,
মারুতিকে আমাদের ভীমরাও আর বুদ্ধের ছবির পাশে? কেন নারকেল দিস পুজোয় বল? জানিস না আমরা
এখন অচ্ছুৎ নই, আমরা হিন্দু নই, আমরা বুদ্ধের এখন?
চন্দা বলল, বাজে বকবি তো এই গরম তেল তোর মাথায় ঢালব। বাবু যখন
জন্মালো তখন তুই ব্রাহ্মণদের মত ওর অন্নপ্রাশন কেন করলি? তোর বাবা-মায়ের শ্রাদ্ধই বা
কেন করেছিলি? জানিস না চন্দন ভাই আমাদের এগুলো করতে বারণ করে যায় প্রত্যেক মিটিং-এ?
তুই শুনিস?
সুরজ চুপ করে গেল। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে
বলল, ছাড়... শুবি যা, আমি দু'পাত্র চড়িয়ে আসি।
চন্দার মনটা বিষিয়ে গেল। সামনের তাকে
রাখা খাণ্ডোবা, মারুতি, ভীমরাও আম্বেদকর, বুদ্ধের ছবির দিকে তাকিয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ।
হাত থেকে তেলের গন্ধ বেরোচ্ছে। আস্তে করে ঘুমন্ত ছেলেটার মাথায় মাখিয়ে দিল। ওকে দেখো
ঠাকুর... আমাদের মত গরীব যেন না হয়.. যেন পড়াশোনা শেখে... মানুষ হয়…. শহরে গিয়ে বাড়ি
বানিয়ে থাকে... আমরা যাব না... আমি আর সুরজ এই গ্রামেই মরব। আমরা শহরে গিয়ে ওকে ঝামেলায়
ফেলবে না। ও সুখে থাকুক।
চন্দার গাল গড়িয়ে জল পড়ল। কোন ঠাকুরের
কাছে প্রার্থনা করল? মায়ের মুখটা মনে পড়ল। মা তাকে নিয়ে কাজে যেত। কাজের বাড়ির মালিকেরা
উঁচু জাতের ছিল। ওদের বাড়ি গৌরিপুজোর দিন ছিল সেটা। মায়ের ইচ্ছা ছিল মা-ও করে, তার
ভাইয়ের জন্য, ভাইয়ের মাথায় কি একটা রোগ ছিল, মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যেত। কে মাকে বলেছিল
যে গৌরি পুজো করলেই তার ভাই সুস্থ হয়ে যাবে।
মা সে কথা ও বাড়ির বড় আঈকে বলতে সে
বলল, গৌরিপুজোয় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালি আমরা, তোদের ও জ্বালতে নেই, জানিস না?
মা কেঁদে বলেছিল, তবে আমার ছেলেটার
নামে যদি একটু পুজো দিয়ে দাও…. বা আমায় একটু ঘি দাও….
তার মায়ের হাতে গরম ঘি ঢেলে দিয়েছিল
ও বাড়ির বড় আঈ। বলেছিল আগেকার দিন হলে ঘি দিয়ে জিভ পুড়িয়ে দিত তার বর…. যে জাতে জন্মেছিস
সেই জাতের মতই থাকবি... গু হয়ে জন্মেছিস গুয়ের মত থাকবি... চন্দনের সঙ্গে মিশতে যাস
না…
তার মা রাতে শুয়ে শুয়ে যন্ত্রণায় কাঁদত।
ততটা শরীরের যন্ত্রণায় না, যতটা মনের। যদিও ও বাড়ির ছোটোছেলে মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে
গিয়েছিল, টাকাও দিয়েছিল চিকিৎসার। ভাই মারা গিয়েছিল আর এক বছর পর। মা কাঁদেনি।
সুরজ বাইরে বটগাছটার তলায় বসে। আকাশে
আধখানা চাঁদ। গলা দিয়ে নেমে গেছে বিষাক্ত সস্তা মদ খানিক আগে। মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করছে।
আরাম লাগছে।
চন্দনভাই ঠিকই বলে, ওই যে হিন্দুরা
দশেরায় রাবণ পোড়ায়, আসলে রাবণ অচ্ছুৎ। ওরা অচ্ছুৎদের সমাজ থেকে ভাগায়। কৃষ্ণ, রাম এরা
ব্রাহ্মণ না হলেও এরা ব্রাহ্মণদের পক্ষে আসলে। এরা ব্রাহ্মণদের হয়ে মেরেছে যাদের, তারা
আসলে অসুর না, তারা আসলে অচ্ছুৎদের প্রতীক। কারোর পুজো করবে না তারা। তাদের একটাই উৎসব,
ভীমরাওয়ের জন্মজয়ন্তী। বুদ্ধের জন্মদিন তেমন কেউ একটা পালন করে না তারা। বুদ্ধকে তেমন
বুঝতে পারে না সুরজ। বুদ্ধের সন্ন্যাসীদের দেখলে ভয় করে। যেন সব কেড়ে নেবে মনে হয়।
সব সুখ, পরিবার, আমোদ আহ্লাদ সব কেড়ে নেবে। কেমন শুকনো ওরা। ওরকম শুকনো জীবন তার চাই
না। তার ভীমরাওই তাদের মত মানুষের জন্য ঠিক... ব্যস... সে হিন্দুদের দেবদেবীও আর চায়
না... আজই ফেলে দেবে সব নিয়ে গিয়ে ওই পুকুরে। জলে ডুবে মরুক শালারা সব।
সুরজ উঠতে যাবে এমন সময় চন্দা বাইরে
এসে দাঁড়ালো। বলল, যতীনের মুখে দানা দানা উঠেছে, গায়ে জ্বর... মনে হচ্ছে পক্স।
এদিকে অনেক বাড়ি পক্স হচ্ছে। সুরজের
বুকটা ভয়ে ফাঁকা হয়ে গেল। কিছু পাপ করল সে? এ কি শাস্তি?
সুরজ ঘরে এসে ছেলের পাশে বসল। সামনে
বসে চন্দা। কাঁদছে, নিঃশব্দে। সুরজ যতীনের মাথায় হাত বোলালো। সে জেগে আছে। ঘুরে গিয়ে
যতীন সুরজের কোলে মাথা রেখে শুলো।
সুরজের বুকটা গরম মোমবাতির মত পুড়তে
পুড়তে গলতে লাগল। সে কেউ নয়, সে কিচ্ছু নয়। সে চন্দার দিকে তাকিয়ে বলল, জানিস চন্দা,
একবার চন্দন ভাইয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম মনে আছে পুণেতে? আমাদের জমির ব্যাপারে কথা বলতে?
চন্দনভাইয়ের বাড়ি গিয়ে দেখেছিলাম কোনো হিন্দু দেবদেবী নেই। চন্দনদা আমাকে বোঝালো যে
হিন্দু দেবদেবী, হিন্দুশাস্ত্র আমাদের জন্য নয়। ওরা আমাদের সব সময় নীচু চোখে দেখবে।
আমাদের ভীমরাওই সব। বুদ্ধ আর ভীমরাওই আমাদের ভগবান। মনে আছে পিশুন ওর বাড়ি গৌরিপুজো
করেছিল, আমাদের সব নেমন্তন্ন করল। গ্রামে ব্রাহ্মণরা এসে আমাদের শাপশাপান্ত করেছিল,
তখন পিশুন কেমন বুক বাজিয়ে বলেছিল, আমরা এখন বৌদ্ধ, আমরা উঁচু জাত এখন, আমরা চাইলেই
হিন্দুদের সব দেবদেবী পুজো করতে পারি….
চন্দা হ্যাঁ বা না কিছু বলল না। সে
তাকিয়ে তার ছেলের দিকে। ছেলে হাঁ করে বাবার কথা শুনছে।
সুরজ বলে চলেছে, চন্দনভাই পিশুনের
কথা তুলে বলল, ও একদিক থেকে ঠিকই করেছে, মাঝে মাঝে ব্রাহ্মণদের ভয় দেখানো উচিৎ, তবে
আমাদের উঁচুনীচু জাত নিজেদের বলার দরকার নেই। আমরা বৌদ্ধ, আমরা আর অচ্ছুৎ নই, আমাদের
সঙ্গে হিন্দুদের আর কোনো সম্পর্ক নেই, এটাই বোঝাতে হবে, ব্যস।
আমি শুনে চলে আসছিলাম জানিস, দরজার
কাছে এসে হঠাৎ চন্দনভাইয়ের মা দাঁড়ালো, আমায় বলল, বাবা আজ সংক্রান্তি, তুমি বাড়ি থেকে
না খেয়ে যেও না, খেয়ে যেও…... তুই বল বৌদ্ধদের কি সংক্রান্তি হয় রে?
চন্দা কোনো উত্তর দিল না। সুরজ বলল,
আসলে আমরা কিছুই নই রে। গ্রামে আমরা একরকম, শহরে আমরাই আবার আরেক রকম। মানুষ আসলে সুবিধা
বোঝে বুঝলি। নইলে বাঁচবে কি করে বল? আমরা পড়াশোনা করিনি তাই আমরা অতশত ধর্মতত্ত্ব বুঝি
না... সমাজের হাওয়া বুঝে চলতে হয় আমাদের…. আমাদের ধর্ম, ভগবান সব সমাজ বুঝে... সমাজই
সব…. বাবুকে অনেক পড়াতে হবে বুঝলি... বুদ্ধ, খান্ডোবা, মারুতি সব থাকুক... ভীমরাও আমাদের
মাথার উপর থাকুক…. অনেক পড়বি তো বাপ?….
জ্বরের ঘোরে, লাল চোখে বাবার ওরকম
উৎকণ্ঠিত মুখ দেখে ভয়ে কিনা জানে না, যতীন তার বাবাকে জড়িয়ে, জয় ভীম, জয় ভীম, বলে কাঁপতে
লাগল।
চন্দার বুকটা ভয়ে শুকিয়ে গেল। মনে
মনে হিসাব করে দেখল ওষুধ আর ডাক্তারের টাকা হবে কিনা। মনে হল হবে। সে সুরজকে বলল, তুমি
শুয়ে পড়ো, কাল আমি ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। তুমি কাজে যেও। ভয় পেয়ো না। কিছু হবে
না।
সুরজ মাথা নেড়ে বলল, আচ্ছা। এই বলে
যতীনকে বুকের কাছে চেপে শুয়ে পড়ল। চন্দা তাকে রাখা ছবিগুলোর দিকে তাকালো। মাথায় কিচ্ছু
আসছে না। শুধু মনে মনে বলছে, এ বিপদটা পার করে দাও ঠাকুর, পার করে দাও….
কাকে বলছে, সে নিজেও জানে না।