জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকে বুড়ি দুটো পেঁপে বার করে পুরোহিতের হাতে দিয়ে বলল, একটু ঝোল রেঁধে খাইয়ো তো, আমায় কাল স্বপ্নে বলল পেটটা ভালো যাচ্ছে না, তোর বাগানে তো ভালোই পেঁপে হয়েছে, আমায় দুটো দিয়ে যাস না।
পুরোহিত বলল, তোমার বাড়ি কোথায়?
বুড়ি বলল, খড়দা...
পুরোহিত বলল, তা তুমি নিজে রেঁধে আনলেই পারতে..
বুড়ি বলল, আমি নীচু জাত... আমার হাতে রান্না আনা কি ঠিক?
পুরোহিত কিছু বলল না। পেঁপে দুটো হাতে নিয়ে, বুড়ির হাত ভর্তি প্রসাদ দিয়ে বলল, যাও গে, মেঘ করছে, তা এই মাহেশ থেকে যেতে তোমায় গঙ্গা পেরোতে হবে.... যাও আর দেরি কোরো না....
বুড়ি ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে ঘাটে এসে পৌঁছালো। প্রসাদগুলো আঁচলে বেঁধে এনেছিল। ঘাটে একটা কোণে বসে খেতে শুরু করল। আকাশ ভেঙে কালো মেঘ করে এসেছে। গঙ্গার ঢেউয়ের কি উচ্ছ্বাস। নৌকাগুলো টলোমলো করছে।
ঠাকুমা, আমায় দেবে?
একটা বাচ্চা। ন্যাংটো। হাত পেতে দাঁড়িয়েছে। জগন্নাথের প্রসাদের আবার আমার তোমার। বুড়ি হাতে যতটা উঠল ততটাই দিল। বলল, বসে খা। আমার সঙ্গে জল আছে দেব। জল খেয়ে নিস।
বাচ্চাটা ঘাটেই হাত পা ছড়িয়ে প্রসাদ খাচ্ছে আর নদীর দিকে তাকিয়ে বলছে, দেখো ঠাকুমা নৌকাখানা দেখো... কি দুলছে মাইরি...
বুড়ি বলল, জগন্নাথ রাখুন ওদের... আমার ভয় করছে....
বাচ্চাটা বলল, ধুর, জগন্নাথের না আছে কান, না আছে হাত... সে তো ডাকলেও শুনবে না... আর শুনলেও এসে ধরতে পারবে না....
বুড়ির রাগ হল। বলল, অমন বলতে নেই.... সে সব শোনে... সব দেখে... তার হাজারটা চোখ... হাজারটা হাত.... বড় হলে বুঝবি.....
বাচ্চাটা পাত্তা দিল না। বলল, দাও জল দাও....
বুড়ি জল দিল। সে ঢকঢক করে খেয়ে বলল, আসি তবে।
বুড়ি ঘরে এলো। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে ফিরেছে। এলো ধুম জ্বর। জ্বরের ঘোর যত বাড়ে, বুড়ি তত দেখে তার কাছে সে ঘাটের ন্যাংটো ছেলেটা বারবার বলছে, একবার রান্না করে খাওয়াবে ঠাকুমা?
বুড়ির জ্বর ছাড়ল। কিন্তু ভাবনাটা ছাড়ল না। ভাবনাটা মাথাতে ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে।
বুড়ি একদিন সত্যিই এটা সেটা রেঁধে শ্রীরামপুর ঘাটে গিয়ে পৌঁছালো। যাকেই দেখে জিজ্ঞাসা করে, হ্যাঁ গো একটা ন্যাংটো বাচ্চা ছেলেকে দেখেছো এদিকে... এই ঘাটেই ঘোরে... এমন দেখতে... এমন চোখ নাক...
কেউ বলতে পারল না।
একজন বলল, আজ তো স্নানযাত্রা, তুমি মাহেশে যাও। দেখো গে সেখানে তো মেলা ভিড়... কত ভিখারি আছে... ওকে পেলেও পেয়ে যেতে পারো....
বুড়ির কথাটা মনে ধরল। কিন্তু ভিখারি কথাটায় দুঃখ লাগল।
মাহেশে ভীষণ ভিড়। বুড়ি এদিক ওদিক খুঁজতে শুরু করল। কিন্তু এত ভিড় ওটুকু একটা মানুষকে খোঁজা যায়?
হঠাৎ কোত্থেকে পুরোহিত হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, একবার রান্নাঘরের দিকে আসবেন? আমাদের রান্নার দুজন আসতে পারেনি, জ্বর।
বুড়ি বলতে গেল, আমার জাত…
পুরোহিত বলল, তা বলে কি জগন্নাথ অভুক্ত থাকবেন?
বুড়ি আর কথা না বাড়িয়ে আবার ঢুকল রান্নাঘরে। জগন্নাথ অভুক্ত থাকবেন? আবার দুঃখ লাগল। কে কাকে অভুক্ত রাখে?
ক’টা আনাজ দিয়ে পুরোহিত বলল, এগুলো কাটো, আমি আসছি…
এই বলে পুরোহিত বেরোতে যাবে, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল, বলল, নাতিকে আনোনি?
বুড়ি হাঁ করে পুরোহিতের মুখের দিকে তাকিয়ে। তার নাতি? তার তো সাতকূলে কেউ নেই….
পুরোহিত বলল, আরে যাকে সেদিন পাঠালে গো মন্দিরে? কি বাঁদর নাতি তোমার... বলে আমার ঠাকুমার গাছের পেঁপের রান্না তোমার ও ঠাকুর খেয়ে তো ভালো মন্দ কিছুই বলবে না... আমিই খেয়ে দেখি কি রাঁধলে….
বুড়ি হাঁ করে তাকিয়ে। কানে কিছু শব্দ আসছে না। হুড়মুড়িয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো যেন কি করে। যেন সেদিনের আকাশ ভাঙা মেঘ আজ তার বুক জুড়ে।