Skip to main content
 
 
        আমরা কি সত্যিই তবে স্বাধীনতাকে ভয় করি? চূড়ান্ত ব্যক্তিগত স্বাধীনতার কথা যতই ভাবি না কেন, অবশেষে তা কি একটা দুঃস্বপ্ন, আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়? ব্যক্তিগত অসীম স্বাধীনতার কথা, আলোচনা, প্রতীক, লড়াই - সব ভালো লাগে, মনের মধ্যে আলোড়ন তোলে, উত্তেজনা আনে। কিন্তু সেই অপরিমিত স্বাধীনতাই যেন অবশেষে একটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। 
 
        নানা দার্শনিকের নানা মত। কিন্তু দর্শন বলো, ধর্ম বলো, নিয়ম-নীতি বলো যা কিছু মানুষ নিজেকে বাঁধবার জন্যেই তো বানিয়েছে। সে কোথাও একটা তার বল্গাহীন স্বাধীনতার ক্ষেত্রকে বাঁধন দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সভ্যতার আদিকাল থেকে।
তার সর্ব প্রাচীন, সুক্ষ্ম শক্তিশালী বাঁধন বোধহয় ধর্ম। কিছুই যখন তার স্বাধীনতার মাথায় শেষ ঘা মারতে পারছে না, তখন এক অদৃশ্য, সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান ঈশ্বরকে সে আবিষ্কার করেছে। স্রষ্টা, নিয়ন্তা, শাসক - ইত্যাদি রূপে দেখতে চেয়েছে। সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছে পিতা-মাতা-সখা-প্রভু ইত্যাদি নামে। ধর্মের ইতিহাস হয়েছে, হায়ারার্কি তৈরি হয়েছে। 
        তবু অবাধ্য স্বাধীনতার ইচ্ছা মাথা চাড়া দিয়েছে। সুপ্রাচীন পাথরের গায়ে তরুণ শীর্ণ গাছের চারার মত শিকড় গজিয়ে ফাটল ধরিয়েছে। পুরোনো ধর্ম সরিয়ে নতুন ধর্ম এসেছে। পুরোনো ইজম গিয়ে নতুন ইজমরা জন্মেছে। ধর্মের সংজ্ঞা বদলেছে, আবেদন বদলেছে, নিয়মাদি বদলেছে, কিন্তু কারণটা একই রয়ে গেছে। তার অসীম স্বাধীনতার প্রতি ভীতি। কে নেবে সে গুরু দায়িত্বভার? 
        নতুন যুগের ধর্মপ্রণেতারা পুরোনোকে সরিয়ে নতুন নিয়ম এনেছে, যদিও বলেছে অনেকেই সব ধর্ম এক। কিন্তু তা অনুষ্ঠানে, বক্তৃতায়, ভাবে-গানে প্রতিফলিত হলেও সমাজে প্রতিফলিত কোনোদিন হয়নি। না প্রাচীন ইতিহাসে, না আজকের খবরের কাগজে। 
        মানুষ নিজের মনকে মন্ত্রে, গুরুতে, সম্প্রদায়ে, বিধি-নিষেধের নিয়মাবলীতে অতি সুক্ষ্মভাবে বেঁধে প্রাচীর তুলে গোষ্ঠী বানিয়েছে। কারণ সে জানে বাঁচতে গেলে দল বাঁধতে হয়। একা একা শুধু তত্ত্বে বাঁচা যায় না। অন্যের বিপদে, যন্ত্রণায় সে ভেবেছে সে তাদের ঈশ্বরের ব্যর্থতা, তার ঈশ্বর তাকে রক্ষা করবেই। আবার তার ঘরে যখন সে বিপদ এসেছে তখন সে অন্য ব্যাখ্যায় নিজেকে ভুলিয়েছে। এইভাবে একই জগতের বৈচিত্রময় নানা ঈশ্বর গড়ে উঠেছে। আবার অনেকে 'সব ধর্ম এক' প্রচার করতেও একটা স্বতন্ত্র দল বানিয়ে নিয়েছে। নিজের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রকট অথবা গুপ্ত ভাব তৈরি হয়েছে। "আমি আধুনিকতম, তুমি প্রাচীন"..."আমি সত্যের, স্থিতির, যুক্তির বেশি নিকটে, তুমি ভ্রান্ত"...এমন প্রহেলিকায় সংসার পাততে হয়েছে। নানা তর্ক, যুক্তি, বাদ-বিবাদে ইতিহাস বর্তমানে দাঁড়িয়ে, বর্তমান ভবিষ্যতের দিকে চলেছে।
        মানুষের মধ্যে অসীম স্বাধীন, মুক্ত যে সত্তা, তাকে যদি পার্সোনিফাই করি, সে একটা একটা পা হাঁটতে শিখছে। যদিও প্রাচীন, মধ্যযুগীয়, অজ্ঞ বর্বরতা মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত আস্ফালন করছে, কিন্তু সেও তো ইতিহাসের নিয়ম। হবেই। তবে তারাও মিলিয়ে যাবে। কিন্তু মানুষ কোনোদিন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতায় বাঁচতে চাইবে না। অসীম সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে সে একটা ভূখণ্ড চাইবেই। অসীম আকাশে উড়তে উড়তে সে একটা ক্ষুদ্র নীড় চাইবেই। এটাই তার সত্তার আয়রনি।