Skip to main content

 

দুর্ভাগ্য মেনে নেওয়ার মত নরম অহংকার ছিল না সদাশিবের। একের পর এক ব্যর্থতায় তাই রীতিমতো পঙ্গু করে দিল। ব্যবসায়, সংসারে সব ব্যর্থতার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিল, এমন কড়া ধাঁচের অহংকার ছিল সদাশিবের। মনে মনে এমন অভিমান জন্মেছিল যে আয়নায় নিজের ছায়া পড়লে ঘেন্নায় চোখ সরিয়ে নিত। পারতপক্ষে তাই আয়নার ধারেকাছেও যেত না।

কিন্তু সব কিছুরই তো একটা শুরু শেষ থাকে। সদাশিবের অহংকারও একদিন সদাশিবকে বলল, জীবনটা রেখেছই বা কেন? আমাকে আর কত নীচ দেখাবে সমাজে? মরো, আর আমাকে রেহাই দাও।

সদাশিব দেখল তার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আসলে দেওয়ালও ছিল না, পিঠও না। তার অহংকারেরই মোটা তুলিতে আঁকা সব। কিন্তু অত গভীরে দেখতে দিলে তো? সদাশিব ট্রেনে চেপে বসল। মরবে যদি, সবার অলক্ষ্যে গিয়ে মরবে। এলাহাবাদে অনেক ছোটোবেলায় বাবার সঙ্গে এসেছিল। সেইখানেই গঙ্গায় ঝাঁপ দেবে।

সদাশিব স্টেশানে অনেকক্ষণ বসে থাকল এলাহাবাদ পৌঁছিয়ে। সিদ্ধান্তটা নেওয়ার পর থেকে হালকা লাগছে। আর তো কিছুক্ষণ। এটুকু সময় হালকা বসে থাকলে কী হয়?

সদশিব স্টেশানে বসে বসে ভিখারিদের দেখে। ভাবে, ইস! আয় না মরবি আমার সঙ্গে। রুগ্ন মানুষকে দেখে। ভাবে, ইস, মরবি চল, আমাদের এখানে কী কাজ? গরীব মানুষগুলোর দিকে করুণায় তাকিয়ে ভাবে, এত লোভ তোদের? তবু আসবি না? ওরে কোনোদিনও বড় মানুষ হতে পারবি না। হলেও আজীবন ভয়ে ভয়ে মরবি। ভাববি, এই বুঝি আবার গরীব হলি। আয় তার চাইতে, সব শান্ত করে দিই। এ জীবন তো আমার ইচ্ছায় পাইনি। তাই শেষ করে দিলেও বা কার কী বলার আছে? আয় আয়।

সদাশিব গঙ্গার উপরে সেতুতে এসে দাঁড়ালো। কাউকে কী স্মরণ করার আছে? নেই। ঈশ্বর তাকে ছাড়াও ভালো আছেন। বাড়ির লোক এমনিই ছেড়ে গেছে। তবে?

সেতুর লোহা আঁকড়ে নীচের দিকে তাকালো। এত সোজা কথাটা তার আগে কেন মাথায় আসেনি? গেলেই তো হয়!

দুটো পা সামনের দিকে ঠেলে দিলেই জল। কিন্তু পা দুটো সরছে না। ভয়ে আঁকড়ে। এই ভয়েই মানুষ নিঘিন্নে জীবন কাটিয়ে দেয়। রোগে, দারিদ্রে, শোকে। গেলেই হয়। তবু যাবে না। এত লোভ, এত ভয় তার।

ঝাঁপ দিল। তলিয়ে যেতে যেতে শ্বাস আটকে এলো। বুকে প্রবল চাপ। শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। শুধু জল জল আর জল।

দুদিন পর ভেসে উঠল সদাশিবের জলে ফুলে ওঠা দেহ।

সদাশিবের মৃত্যুর কয়েক দশক পরে আবার জন্মের সুযোগ পেল সে। দেবদূত জিজ্ঞাসা করল, আবার কি জন্মাবে?

সদাশিব বলল, হ্যাঁ।

ধন চেয়েছিলে, সুঠাম, নীরোগ শরীর চেয়েছিলে। যদি না দিই? তবু কি জন্মাবে?

সদশিব বলল, হ্যাঁ। জন্মেই তো আছি। ভুলতে পারলাম কই? সব কথা স্মৃতিতে আঁকড়ে বেঁচে আছি। এ সব ভুলতে আরেকবার যেতেই হবে।

দেবদূত বলল, কী করে ভুলবে?

সদাশিব বলল, যে দুর্ভাগ্যের দিকে পিঠ ফিরিয়েছিলাম…তাকে স্বীকার করে নিই…. আমি ঠেলেছি বলেই সে আমাকে ছাড়েনি….এবার আমার সঙ্গে মিশিয়ে নেব….সে ছেড়ে যাবে আমাকে কাঙাল করে….শ্রাবণ যেমন সব জল উপুড় করে ঢেলে তবে শরতের হাতে আকাশকে দিয়ে যায়....তেমন....আমি শূন্য হয়ে মুক্ত হব…..

দেবদূত বলল, যাও তবে। নিজের ভাগ্যকে বেঁচে এসে শূন্য করো তাকে। এ অধ্যায় হোক শেষ।

সদাশিব গঙ্গার উপরে সেতুর উপর দাঁড়িয়ে বলল, যাই….