মনের একটা সদর দরজা আছে। সেই দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলে সার দিয়ে কত যে ঘর তার ঠিকঠিকানা নেই। তবে মুশকিল হল সে ঘরের চাবিগুলো আমার হাতে নেই। কার হাতে যে আছে তাও জানা নেই। তবে কারোর হাতে নিশ্চয় আছে। সে রাতের তারা, ভোরের আলো, মল্লার না বেহাগ, কার ছেড়ে যাওয়া, কার ফিরে আসা, কার কটুকথা, কার হাসি, কার প্রাণজুড়ানো ভাষা, কোন প্রজাপতির গায়ের রঙ, কোন কবিতা, কার দৃষ্টি... কে বলবে? এমনকি নিজের জীবনেও কার হাতে কোন ঘরের চাবি খুলেছে সে হিসাব কি দিতে পারি? পারি না।
সে ঘরগুলোর সামনে একটা টানা বারান্দা আছে। আমি দেখেছি। সে বারান্দায় বসে থেকেছি। চেয়েছি কোনো একটা ঘরের অন্তত দরজা খুলি আজ, পারিনি। হতাশ হয়েছি। সদর দরজার দিকে তাকিয়ে থেকেছি, কেউ কি এলো? চাবি কি আছে কারোর হাতে ওদের? আসেনি। এক পলকের অপেক্ষা যুগান্তরের অপেক্ষায় গিয়ে ঠেকেছে। তবে এটুকু বুঝেছি আজা এতটা পথ হেঁটে এসে, যে ঘর যখন খোলার সে ঘর তখন খুলবেই খুলবে। আমার কাজ শুধু সদর দরজাটায় কপাট না দেওয়া। আমার যত ব্যস্ততাই থাক না কেন, আমি যেন আমার মনের একটা দিক সেই দিকে দিয়ে রাখি, কেউ যেন অনাদরে ফিরে না যায়। কার হাতে কোন ঘরের চাবি তা তো জানি না, না?
কোনো ঘরের দরজাটা খুললে এমনও মনে হয়েছে, হায় রে এ ঘরটা না হয় বন্ধই থাকত? কিন্তু অনেক কাল পরে বুঝেছি সেই ঘরে কোনো একটা তুচ্ছ সামগ্রীও আমার জীবনকে ভরে নিতে ব্যর্থ হয়নি। জীবনের কোনো অভিজ্ঞতাকেই তো আর অমূলক বলা চলে না। তাই যে ঘরের যে অভিজ্ঞতা সেই ঘরের দরজাটা খুললে তা হবেই। একটা ঘরের দরজা আটকে দিলে পরের ঘরের দরজাও আটকে যাবে যে।
অন্যমনস্কতায় বাইরের দরজাটার সামনে বসতে ভুলেছি যেদিন সেদিন সত্যিকারের অনর্থ ঘটেছে। জীবন থেকে কয়েক মুহূর্ত পড়েছে বাদ, অবহেলায়। তাদেরও রাখতে পারতাম ঘরের কোথাও, যদি সে কোনো ঘরের চাবি নিয়ে এসে থাকত। কিন্তু নিজের অমনোযোগিতায় তা হারিয়েছি। ক্ষণ যদি হারায় তবে সে চিরটাকালের জন্যেই হারায়। জীবনের বরাদ্দ আয়ুতে যতটুকু পাই তার এতটুকু অপচয় বড় গায়ে লাগে। প্রতিদিনের সব চাইতে বড় কথা তো এই, সেই দিনটাতেও বেঁচে আছি। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণই তো কানের কাছে মৃত্যুর পাড় ভাঙার শব্দ শুনছি। জানি তো সে এক পা, এক পা করে আমার দিকে এগোচ্ছে। আমার অন্যমনস্কতায় তো তার গতির বেগ কমবে না। তার কোন ঢেউ যে আমায় নিতে আসবে তাও তো জানি না। তবে? তবে এই যে সদর দরজাটা হাট করে খুলে রাখা। একটা ধুলিকণাও যেন আমার নজর এড়িয়ে আমার সামনে দিয়ে সদর দরজাটা এড়িয়ে না যায়। যে আসতে চাইবে না সে না আসুক, কিন্তু যে আসতে চায় সে যেন অনাদরে না ফেরে।
এবার বারান্দার কথা বলি। ওই বললাম ঘরগুলোর সামনে সার দেওয়া বারান্দা। অনেকের দেখেছি, সে বারন্দায় ভর্তি সামগ্রী। আসলে সে যা পেয়েছে জড়ো করেছে। কিন্তু ঘরে তুলবে যে চাবি কই? তাই বারান্দায় সব জড়ো করে, সদর দরজায় তালা ঝুলিয়ে, সারাটা জীবন ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে মাথা কুটে মরছে। তার সাধ তার নিজের ইচ্ছামত কয়েকটা ঘরের দরজা খুলে সে ঘরেই সে কাটিয়ে দেবে। আরে তাই কি হয়? কিন্তু কে তাকে বোঝায়? তাকে যে লোভে পেয়েছে। লোভ মানে বারান্দাকে ঘর করে তোলা। শ্রী হারায়। আনন্দ হারায়। অর্থ হারায়। হারায় না শুধু জমানোর নেশা। যতটুকুতে স্বাভাবিক ছন্দ থাকত তা ভেঙে গিয়ে একটা যান্ত্রিক আওয়াজে কানে তালা ধরে যায় - সে ভাবে এই খুব বড় একটা কাজ হচ্ছে। তারপর বারান্দাতেই ছাওনি দিয়ে, সোনার রঙে কয়েকটা ঘর বানায়। বলে, এ আমার, একান্তই আমার। বাইরে বসন্তের হাওয়া তার সদর দরজায় ধাক্কা দিয়ে ফিরে যায়। শরতের আকাশ সাদা মেঘের উৎসব সাজিয়ে তার দরজায় এসে ব্যর্থ হয়। সে মজে থাকে তার বারান্দার ঘরে। মাঝরাতে চমকে চমকে ওঠে, ওই বন্ধ ঘরগুলো থেকে কাদের যেন কান্না শুনতে পায়, দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায়। সে কানে হাত দিয়ে চেপে ধরে বলে - সব মিথ্যা... এ সংসারে আমার আমি ছাড়া বাকি সবটাই অর্থহীন... মিথ্যার বেসাতি।
কোনো একদিন আকাশে মেঘ জমে। সে টের পায় না। বাতাসের বেগ বাড়ে, সে তাও টের পায় না। দরজাটার জং লাগা কব্জাগুলো মুক্তির আনন্দে উল্লসিত হয়ে ওঠে, সে শোনে কান্নার আওয়াজ, আর্তনাদ। অবশেষে সে সদর দরজা ভেঙে পড়ে। তার সাজানো বারান্দার সব শূন্যে উড়ে যায় মিলিয়ে। বন্ধ ঘরগুলো থেকে তার রিক্ত আয়ুর দীর্ঘশ্বাসের গরম বাতাস মুক্ত হয় বাইরের খোলা বাতাস পেয়ে। সেই রিক্ততাই সম্পদ তার তখন, সে বোঝে, আবার বোঝেও না। তার সময় ফুরিয়ে এসেছে যে, তার সদর দরজার কাছে তখন মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছে, বলছে, এসো।
সৌরভ ভট্টাচার্য
3 June 2018