Skip to main content

গুরুতর ভালোবাসার অভাব নিয়ে মানুষটা বেঁচে ছিল। তার সবসময় মনে হত সে যখন তখন যা খুশী করে ফেলতে পারে। অহংকারকে ইচ্ছা ভেবে গুলিয়ে ফেলতে ফেলতে লোকটা যখন একেবারে খাদের ধারে - তখনই তার মাথায় জড়ানো জরির কাজ করা পাগড়িটা খসে গিয়ে পড়ল খাদে।
       তারপর কি হল বলো তো? লোকটা হামাগুড়ি দিয়ে, ভয়ে ভয়ে, হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিজেকে নিয়ে উঠতে লাগল। কি তার সে বুকের ধুকপুকানি রে বাবা, মায় পাহাড়ের পাথরগুলো পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে উঠছিল!
       মানুষটা ভয়কে ভাবল অহংকার। অথচ বোকাটা জানলই না, পাগড়ির সাথে খসে গেছে তা কবে। সে পাহাড়ের মাথায় একটা গোল চাতালে বসে চারদিক তাকিয়ে দেখল... কি দেখল? যা! কেউ কোত্থাও নেই... সে একা বসে আছে। লোকটা এত ক্লান্ত ছিল যে ঘুমিয়েই পড়ল।
       ঘুম যখন ভাঙল, বলো তো এবার কি দেখল? দেখল এক আকাশ তারা মিটমিট করে তার দিকে তাকিয়ে। চারদিকে জোনাকি জ্বলছে ঝোপে ঝোপে। সে গুটিগুটি পায়ে আবার খাদের দিকে এগোলো। কেন এগোলো? সে আমি জানব কি করে বাপু? আমি কি ওর মনের মধ্যে সেঁধিয়ে বসে আছি?
       তো সে ধীরে ধীরে খাদের কাছে গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। ঝুঁকে দেখে, উই নীচে একটা সরু নদী। নদীর গায়ে আকাশের যত তারা যেন বিন্দু বিন্দু আলপনা দিয়ে রেখেছে, টলটল করছে। সে তার পাগড়িটা খুঁজতে শুরু করল। পাগড়ি ছাড়া সে লোকালয়ে যায় কি করে? এই না ভাবতে ভাবতে সে ওইভাবেই আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
       ঘুম ভাঙল যখন তখন তার মাথাটা ভার। কি হয়েছে ভেবে যেই না সে নড়তে যাবে, অমনি একটা লাল ঠোঁট বেগুনি রঙের পাখি তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, নোড়োনি গো, নোড়োনি... আমি এইমাত্তর বারোটা ডিম পাড়লুম দেখো, তুমি আড়াই মাস এমনি চুপটি করে শুয়ে থাকো, দেখো ওরা উড়তে শিখলেই আমি ওদের নিয়ে চলে যাব।
       মানুষটা আর কি করে, 'আচ্ছা', বলে শুয়ে রইল। পাগড়িটা না থাকাতে মাথাটা বেশ হালকাই লাগছে, সেটা ভালো না মন্দ ভাবতে ভাবতে তার দুই হপ্তা গেল কেটে।
       হঠাৎ একদিন মাথার মধ্যে একটা ফিসফিস শব্দ শুনল। কে কথা বলছে? হাত দিতে যাবে, অমনি সামনের বিশাল গাছটা ঝুঁকে বলল, নোড়োনি গো, নোড়োনি, আমি গতকাল রাত্তিরে দুটো বীজ পুঁতেছি তোমার মাটি লাগা চুলে, ওরা অঙ্কুরিত হচ্ছে, দেখো। একটু বড় হলে ওরা নিজেরাই অন্য শিকড়ে ভর করে তোমার মাথাটা মুক্ত করে দেবে।
       এরপর কতদিন ধরে বৃষ্টি হল। তার মাথায় নদী হল, শীতকালে ঠাণ্ডায় বরফ হল জমে জমে। তারপর হল কি, সে নদীর জল তার বুকের ভিতর চুপিচুপি একটা হ্রদ বানালো। নাম হল মানস সরোবর। সেই দীঘিতে চাঁদের ছায়া, তারার ছায়া, সূর্যের ছায়া তো ভাসেই, কিন্তু তার নিজের মুখটা বাড়ালে, নিজের ছায়া আর দেখা যায় না। একি কিরকম কথা? আশ্চয্যি বনে যায় জানো লোকটা এতসব দেখতে দেখতে। তবে আসল আশ্চয্যির কথাটা তো এখনও বলিইনি... বলব? আচ্ছা, বলেই দিই। লোকটা মাঝেমাঝেই দেখে সেই সরোবরে একটা সাদা হাঁস স্নান করতে আসে। কোথা থেকে আসে, আবার কোথায় মিলিয়ে যায় বোঝাই যায় না। কি তার সৌম্য সৌন্দর্য, তার হাঁটাচলা যেন রাজার মত। স্থির হয়ে যখন চোখদুটো মুদে সে ভাসে তার বুক জুড়ে... মানুষটা যেন হারিয়ে যায়... যেমন ঝড়ের বেগে শিমূলতুলো তার আবাস ফেটে হাওয়ায় উড়ে যায়, সেও যেন তেমন উড়ে যায়, মিলিয়ে যায়। মানুষটা বিভোর হয়ে যায়।
       এই হল গপ্পোটা। এখন যদি ওদিকে যাও, মনেই হবে না ওখানে অমন একটা আস্ত মানুষ শুয়েছিল একদিন পাগড়ি হারিয়ে। এখন সেখানে নদী, পাহাড়, জঙ্গল, সরোবর। তবে কেউ কেউ বলে একটা সাদা হাঁসের গল্প। যার গায়ের উপর নাকি মাঝে মাঝে রামধনুর মত নানা রঙের পালক। সব মিলিয়ে গিয়ে সে রঙ নাকি সাদা, আর যারা দেখতে পায় না, তাদের জন্য কালো।