Skip to main content
 
 
      দশজন মানুষ আয়নাতে মুখ দেখছিল। ছোটো ছোটো আয়না। হাতে ধরা। একে অন্যের আয়নায় মুখ দেখতে ভয় পাচ্ছিল। অন্যের আয়নায় যদি নিজের মুখ না দেখিয়ে যার আয়না তারই মুখ দেখায়?
      একজন তবু খানিক সাহস সঞ্চয় করে আড়চোখে, একটু কাত হয়ে অন্যের আয়নার দিকে তাকাল। তার নিজের মুখের এক চতুর্থাংশ আয়নায় দেখল। তার মানে বাকি মাথাটা সে কেটে দিয়েছে? - এই ভেবে হৃৎযন্ত্র বিকল হয়ে মারা গেল।
      সবার মধ্যে একটা হইচই পড়ে গেল। যে যার আয়না হাতের আড়ালে লুকিয়ে চুপ করে বসে থাকল। কেউ কারোর দিকে তাকাচ্ছে না। সবাই যে যার মাথার চুলগুলো সামনের দিকে এনে মুখটা ঢেকে বসল।
      সমুদ্রে ঢেউ। বাতাসে ফুলের গন্ধ। আকাশে মেঘের আনাগোনা। মৌমাছিদের গুঞ্জন। গরুদের মাঠে চরা। সব হতে লাগল। কিন্তু ওই ন'জন না নড়ল, না কথা বলল, না কেউ কারোর দিকে ফিরে তাকালো।
      কয়েক শো বছর পর অন্য প্রজন্মের মানুষ এদের খুঁজে পেল। তখন চারদিকে সেকি জঙ্গল। তারা এসে দেখল ন'টা মানুষের কঙ্কাল, তাদের প্রত্যেকের পাশে একটা করে আয়না পড়ে। কাঁচগুলো ভাঙা। মুখ দেখা যাচ্ছে না। ভাঙা আকাশ। ভাঙা জঙ্গল। এমনকি মুখগুলোও ভাঙা ভাঙা। তারা কঙ্কালগুলো ওঠাতে গেল, পারল না। এত ভারী। মাটি খুঁড়ে গর্ত করে কঙ্কালগুলো চাপা দিয়ে গেল।
      আরো কয়েক শো প্রজন্ম পর অন্য মানুষ এসে দেখল, একটা মরুভূমি। কেউ বলল, এখানে জঙ্গল ছিল এককালে। কেউ বলল, এখানে দশজন মানুষ থাকত এক সময়ে। কেউ বলল, সব মিথ্যা, এখানে এমনই মরুভূমি ছিল চিরকাল।
      মরুভূমির উপরে হাঁটতে গিয়ে একজনের পায়ের তলায় বিঁধল কাঁচের টুকরো। হাতে নিয়ে দেখল। মনে হল যেন ভাঙা আয়না। লুকিয়ে রেখে দিল। এই কাঁচের টুকরো দিয়ে সে এক ব্যবসায়ীর শিরা কেটে দেবে। তার সাথে নানা দেশের মুক্তো, সে দেখেছে।
সেদিন পূর্ণিমার রাত। সবাই ঘুমাচ্ছে। কিছু দূরে মরুভূমির বালিগুলো চিকচিক করছে জ্যোৎস্নায়। লোকটা কাঁচের টুকরো নিয়ে উঠল। ধীরে ধীরে, পা টিপে টিপে সেই ব্যবসায়ীর কাছে গেল। গলার শিরাটা এক টানে কেটে দিল। ব্যবসায়ীটা একবার নড়ে স্থির হয়ে গেল। তার গলা থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে মাটিতে একটা ধারাস্রোত তৈরি করল। তারপর রক্ত কুলকুল করে মরুভূমির দিকে এগিয়ে গেল। মরুভূমি যেন দুটো হাত বাড়িয়ে সেই রক্ত চোঁ চোঁ পান করল। তারপর তৃপ্তিতে বলল, আ..হা!! অমনি একটা বালিঝড় হল। লোকটা দেখল দশটা মানুষ বালিঝড়ের মধ্যে ঘুরে ঘুরে নাচছে, কিন্তু কেউ কারোর দিকে তাকাচ্ছে না।
 
      এমন সময় একটা তারা খসল। চারদিক নীল রঙের আভায় ভরে গেল। ঝড় থেমে গেছে। নিঃশব্দ চারদিক। একটা সাদা পেঁচা গাছের ডালে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে। তার চোখদুটোয় কি করুণ প্রার্থনা।
      লোকটার কান্না পেল। সে মৃত ব্যবসায়ীর শরীরের উপরে তার মুক্তোগুলো ছড়িয়ে দিল। তার মৃত চোখের পাতার উপর একটা চুমু খেল। তারপর নিরুদ্দেশ হল। একা।