গাড়িটা নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। শরতের মেঘের হাওড়ার ঘিঞ্জি বাজারের উপরে কোনো মহত্ব থাকে না। শুধু অল্প অল্প শীত গরম মেশানো বাতাস ছাড়া শরত বলতে কিছু নেই এখানে। আমার গলিটা অল্প অল্প মনে আছে। সামনের ফলের দোকানের পাশ দিয়ে যে গলিটা গেছে সেইটাই মনে হচ্ছে।
আমার নতুন শার্টটা থেকে দোকানের গন্ধ আসছে। যেন শার্টটা এখনও দোকানের তাকে প্যাকেটে ভাঁজ করে রাখা। শার্টটার পকেটে একটা কাগজের টুকরো। সাদা কাগজে নীল কালিতে লেখা। সাদা পাতাটা বিল্টুর অঙ্ক খাতা থেকে নেওয়া। বিল্টু ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। এখন বিয়েবাড়ির আনন্দে মশগুল।
গলিটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। নার্ভাস লাগছে। ভয় করছে। সামাজিক ভয়। লোকভয়। ঘাম হচ্ছে। আমার নতুন কিটোটা আর পায়ের মধ্যেটায় ঘামের নদী বইছে যেন। বাঁধা না থাকলে পা'টা এতক্ষণে ভেসে যেত, কি বলছি, পিছলে যেত।
বুক পকেটে রাখা নিরীহ চিঠি একটা - "আমি এ বিয়েটা করতে পারব না" - মাত্র কয়েকটা শব্দ। একটু পর অ্যাটোম বোমের মত ফাটবে।
বিয়েবাড়িটা ভাড়া নেওয়া। তার পাশে ছেলেদের বাড়ি। ছেলে ব্যাঙ্কে চাকরি করে। সারা ভারতে অসংখ্য মানুষ ব্যাঙ্কে চাকরি করে। মানুষের অস্তিত্বে দুটো ধারা যায় পাশাপাশি। মানুষ নিজেই নিজের প্রতিযোগী। যেমন দিদি, পিসির মেয়ে। সমস্ত প্রতিযোগিতা থামতে থামতে আজ সকাল হল। ছক ভেঙে গেল। হিসাব হারিয়ে গেল। "অর্ণবকে ছাড়া বাঁচব না" - এই একটা বাক্য মাথার মধ্যে স্পষ্ট হতে এতগুলো মাস কাটিয়ে দিল। সবাই বলবে, এতদিন কি করছিলি তবে? আমি জানি উত্তরটা। ওরাও সবাই জানে। সমাজকে ডিঙিয়ে এই স্পষ্ট কথাটা স্পষ্টভাবে জানা খুব কঠিন কাজ। তবে জেনে গেলে আর লুকানো যায় না। এখন যেমন পারমিতা আর পারছে না। সে মরিয়া। প্রতিযোগিতার ফল বেরিয়েছে। পারমিতার হৃদয় জিতে গেছে। সে ট্রফি হাতে সব কিছু ভেঙে ফেলতে চাইছে। ভয় পাচ্ছে, আবার কোনো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতে পারে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বনাম সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। মৃত্যুর মত সুনিশ্চিত জীবনে কিচ্ছু নয় - এ দার্শনিকের কথা, প্রেম মরিয়া হলে দর্শন খোঁজে। দর্শন আকাশে ওড়া সাদা বকের মত। যখন তখন ধরা দেয় না, একি কাক?
“হতাম যদি বনময়ূরী তোমায় নাচ দেখাতাম”... চেনা গান, এখন অচেনা। এখন নয়েজ। সব কিছু নয়েজ এখন। চারদিকের এত চীৎকার হইহুল্লোড় সব নয়েজ। মানুষের কোনো গোপন অভিসন্ধি থাকলে বাইরে সব কিছু অর্থহীন হয়ে যায়। চলমান আলোকিত জগতের থেকে লুকানো অভিসন্ধি শুধু তার নিজের। বুকের মধ্যে মাকড়সার মত বসে আছে। সুযোগের অপেক্ষায়।
আমায় কেউ চেনে না এরা। আমি এখানে থাকি না। যতদূর জানি বিয়ে বাড়িটার পিছনেই বাড়িটা। ঠিক তাই। আলোতে সাজানো। টুনিগুলো না জ্বললে বাড়িটার গায়ে আবর্জনার মত লাগছে। দোতলা সবুজ বাড়ি। নতুন রঙ। একজন বয়স্ক মানুষ লুঙ্গি পরে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে। এদের বাড়িরই কেউ হবে। এখন নার্ভাস লাগছে না। এখন কি লাগছে বুঝতে পারছি না আর। আমি নিজেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আমি হেঁটে হেঁটে ওনার সামনে গিয়ে ভীষণ নম্রভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, সজলদার সাথে দরকার একটু।
সজলদা হাবিবে গেছে। আমায় দোতলায় নিয়ে যাওয়া হল। গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিতে এসেছি? এত তাড়াতাড়ি? হাসাহাসি, মজা, ঠাট্টা, আপ্যায়ন। সব সাজানো। এরাই আবার যে যার বাড়ি গিয়ে অন্য মানুষ। কেউ রাগী, কেউ বিষণ্ণ, কেউ সন্দেহবাতিক, কেউ উন্নাসিক, কেউ ফাজিল। উৎসবে এসে সবাই একরকম, প্লেজেন্ট পার্সোনালিটি।
আমার সামনে ময়রার দোকান সাজানো। আমার এখনও লুচির ঢেকুর উঠছে। বেশি লুচি খেলে আমার ঘুম পায়। এখনও পাচ্ছে। এত নতুন জামার গন্ধে, ফুলের গন্ধে, হইহুল্লোড়ে আমার ঘুম পাচ্ছে। বুক পকেটে কাগজটা শ্বাস নিচ্ছে জোরে জোরে। আচ্ছা অর্ণবদা এখন কোথায়? অর্ণবদার বাবার মুদির দোকান। অনেক ছোটো বাড়ি। অর্ণবদা বাংলা পড়ায়, বাড়িতেই। দিদির পলিটিক্যাল সায়েন্স ছিল। অর্ণবদা সজলদাকে চেনে। সজলদা চার বছরের বড়। সমাজ মতে দিদির বিয়ে সজলদার সাথে হওয়ার কথা নয়, কারণ সজলদারা শিডিউল কাস্ট, দিদিরা ব্রাহ্মণ, অর্ণবদারাও। কিন্তু চাকরি?
কি পড়ো তুমি?
থার্ড ইয়ার, ইকোনমিক্স
সিভিল সার্ভিস দেবে?
সজলদার বাবা। কেন্দ্রীয় সরকারে চাকরি করেন। বলে যাচ্ছেন –
দেখো বাঙালির ছেলেরা তো ওইসব চাকরি পায়টায় না, সব বিহার, ইউপি খেয়ে নিচ্ছে। তোমার বাবা কি করেন?
কাস্টমসে...
তুমি কেমন আত্মীয় হও মঞ্জুদের? ( মঞ্জু মানে আমার পিসি)
একটু দূরের…
তুমি সজলকে চেনো?
ওই ফেসবুকে কথা হয়েছে
তুমি আছ ফেসবুকে? আমিও তো আছি, দাঁড়াও তোমায় একটা রিকুয়েস্ট পাঠাই... কে আছিস, আমার ফোনটা একটু ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে এনে দে তো রে... চার্জে বসানো আছে..... আমার আবার কবিতা লেখার নেশা... একবার তো সুনীলের বাড়িও গেসলাম... মানে সুনীল গাঙ্গুলি... আহা... কি অমায়িক মানুষ... আমার কবিতা শুনলেন... উৎসাহ দিলেন... সে সব দিন কি বলব তোমায়... পাগলামি... স্রেফ পাগলামি... জীবন মানে যে আইডিয়াল একটা কিছু...ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারবে... ওসব আইডিয়াল বলে কিস্যু হয় না... নিজেকে বেচো... উপরে ওঠো... তোমার ভিতরে মশলা থাকলে বাজারে দর আছে... নইলে ফক্কা... এই এই নাও, তোমার নামটা সার্চ করো তো...
সার্চ করা হল না, তার আগেই সজলদা এসে গেল।
কিরে তুই?
দাদা, তোমার সাথে আমার একটু কথা আছে...
সজলদা কাগজটা নিল। সিগারেট ধরালো। আমায় বলল, তুই যা। এখনই কিছু জানাস না।
আমি এক প্রকার দৌড়ে এসে বড় রাস্তায় দাঁড়ালাম। বাড়ি যাব। ফোন সাইলেন্ট করা ছিল, নরম্যাল মোডে আনতে গিয়ে দেখি অর্ণবদার আটাশটা মিসড কল। কল করলাম,
তুই বেরিয়ে গেছিস?
হ্যাঁ
কাগজটা?
দিয়ে দিয়েছি...
কি বলল? আচ্ছা দাঁড়া, তুই ওদের বাড়ির থেকে দূরে তো?
হ্যাঁ
তুই শ্যামসুন্দর শাড়ির দোকানের সামনে দাঁড়া আমি আসছি, পাঁচ মিনিট।
আমার বুকের মধ্যে হাপর পেটাচ্ছে। আমি যেন কোথাও একটা জিতে গেছি। শ্যামসুন্দর অবধি অটোতে এলাম। পঁচিশ মিনিট পর অর্ণবদা এলো।
তুই পারমিতাকে বোঝা, ও পাগলামি করছে, আমার সে অবস্থা নেই যে আমি ওকে অন্তত সামনের পাঁচ সাত বছরের মধ্যে বিয়ে করতে পারব... চেষ্টা তো করেই যাচ্ছি... হচ্ছে কিছু? কিচ্ছু না...
উচ্চমাধ্যমিকে আমার সায়েন্স ছিল। কেমিস্ট্রি ল্যাবে একবার আমার গায়ে নাইট্রিক অ্যাসিড পড়ে যা তা কাণ্ড হয়েছিল। খুব অল্প পড়েছিল। কিন্তু ভয় আর এম্ব্যারাসমেন্টের চোটে স্কুলে যাইনি এক সপ্তাহ। পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করত। ক্লাসে সবাই আমার খালি গা দেখেছিল। মেয়েগুলোর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমার এখন আবার পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। অর্ণবদার কথাগুলো অনেকবার রিহার্সাল করা, নয় তো বহুবার উচ্চারণ করা। বলার থেকে আমার প্রতিক্রিয়াটা বুঝতে চাইছে, আমায় দিয়ে মিশন ক্লিয়ার হবে কিনা, বাজিয়ে দেখছে। ফোন বাজল...
হ্যাঁ সজলদা, আমি ওর সাথেই কথা বলছি... না না তোমায় আসতে হবে না... আমি ম্যানেজ করে নেব... তুমি ভেবো না... ও পাগলামি করছে... জাস্ট সেন্টিমেন্টাল হয়ে গেছে... আমি জানি লাইফ চলে না ওতে...
আমার কষিয়ে অর্ণবের বিচিতে একটা লাত্থি মারতে ইচ্ছা করছে।
আমি শুধু শুনে গেলাম টানা চল্লিশ মিনিট। আমায় বাইকে ছেড়ে দিয়ে গেল। বন্ধুর বাইক। ভিখারি শালা।
দিদির গায়ে-হলুদের তত্ত্ব এসে গেছে ও বাড়ি থেকে। “ঝুমকা গিরা রে”... এ গানটা ভালো গান। অনেক ভালো গান। দিদির মুখের দিকে তাকাতে কান্না পাচ্ছে। তাকাবো না। কিন্তু কোথায় যাব? বাড়ি যাওয়া যাবে না। সিন ক্রিয়েট হবে। দিদিকে এড়িয়ে যাচ্ছি। সারাটা বিয়ে এড়িয়ে গেলাম। সজলদাকেও।
বউভাতের দিন আমায় মাঝখানে নিয়ে দু’জনে দু’পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলল। কেউ কিচ্ছু বলল না। আজও না। আজ হঠাৎ পুরোনো ছবি ঘাঁটতে ঘাঁটতে এই ছবিটা হাতে এসে পড়ল। ওদের এখন চোদ্দো বছরের মেয়ে। অনলাইন ক্লাস করছে নাকি। সজলদা আর ওরা গুয়াহাটি আছে। অর্ণবদা বিয়ে করেছে। এখনও টিউশান পড়ায়, বাবা মারা গেছে, দোকানটাও চালায়। সাদা বকটা কোনো গাছে আশ্রয় না পেয়ে উড়ে গেছে। আকাশ জুড়ে শুধু কাক আর কাক। আমি মাঝে মাঝে সজলদার বাবার কবিতা পড়ি। খারাপ লেখেন না ভালো লেখেন জানি না। তবু কোথাও এখন ওনাকে ভালোই লাগে। মনে হয় অন্তত এখনও উনি আকাশে সাদা বকটাকে খুঁজেই যাচ্ছেন।