সমালোচনা এক, নিন্দা গালাগাল আরেক। সাবাশ ফেলুদা, ওয়েব সিরিজ, আইএমডিবি রেটিং ৫.৬। মানে যথেষ্ট খারাপ। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিন্দার ঝড়। ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, অশ্লীল শব্দ --- সব চলছে। ইমোজিতে রাশি রাশি ‘হা হা’। অনেকেরই মূল সমস্যা হচ্ছে, তারা চেনা-পরিচিত ফেলুদাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। তোপসের কেন গার্লফ্রেণ্ড আছে? ফেলুদাকে কেন বাচ্চা দেখাচ্ছে? (সঙ্গে কিছু অশ্লীল গ্রাম্য শব্দ)। আরো অনেক কিছু। এটা তো সত্যজিতের ফেলুদা না, এটা তো অরিন্দমের ফেলুদা।
সত্যজিৎ রায় ফেলুদা দুটো বানান, একটা ১৯৭৪ সালে, সোনার কেল্লা; দুই, ১৯৭৯ সালে, জয়বাবা ফেলুনাথ। সন্দীপ রায় তারপর পর পর বেশ কিছু ফেলুদা সিরিজ বানান। জনপ্রিয় হয়।
বাঙালি সত্যজিতের ফেলুদার মধ্যে একটা ঘরানা খুঁজে পায়। একটা বিশেষ আবহসঙ্গীত। কয়েকটা সিগনেচার জেশ্চার। কিছু নির্দিষ্ট বাক্যবন্ধ। সন্দীপ রায়ের ফেলুদা সেই ছাঁচের বাইরে খুব একটা পা রাখেনি, তাই গেল গেল রব ওঠেনি।
এবার উঠল, কারণ অরিন্দম শীলের ফেলুদা সত্যিই অরিন্দম শীলের ফেলুদা। শুধু যে সময়টা অনেক এগিয়ে এসেছে বলে না, সিনেমা দেখার ধরণটাও অনেক বদলে গেছে। এখন ওটিটি-র যুগে গল্প বলার কায়দা অনেক বদলে গেছে। সেই বদলের হাত ধরে অরিন্দম শীলের ফেলুদার মধ্যে বদল এসেছে। এখন দেখতে হবে বদলটা সদর্থক, না নঞর্থক। কিন্তু সেটাকে ভালো করে বুঝতে গেলে তো ঘরানার ভাবনাটা থেকে বের হতে হবে।
প্রথমে আমার ব্যক্তিগত কথা দিয়ে শুরু করি। আমার মনে হয়েছে, সত্যজিতের পর অরিন্দম শীলের ফেলুদা'র মত এত পরিণত ফেলুদার সিনেমা আমি দেখিনি। মাঝখানে যতগুলো ফেলুদা হয়েছে সেগুলোকে আমার কোথাও অনুকরণ মনে হয়েছে। স্বকীয়তার জায়গা খুব কম দেখেছি। আমার ভালো লাগেনি তাই। দ্বিতীয়বার কোনো ফেলুদাই দেখা হয়ে ওঠেনিও সেই জন্যে। যখন প্রচণ্ড নিন্দার ঝড় উঠেছে তখন ভালো করে নিন্দার পয়েন্টগুলো পড়ে বুঝতে চেষ্টা করে দেখলাম এতে শিল্পের গুণগত সমালোচনা বিন্দুমাত্র পাচ্ছি না, যা পাচ্ছি তা হল বিশেষ ধরণের ঘরানার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না বলে এত আপত্তি।
প্রথম কথা পরমব্রতকে মানাচ্ছে না। কিসের ভিত্তিতে মানাচ্ছে না? চেহারায়? সেটা তো ভীষণ আপেক্ষিক। পরমব্রত ভীষণ বেঁটেখাটো গোলগাল মানুষ হলে হয় তো অন্যরকম লাগত। সেটা তো পরমব্রত নন। লম্বা, ছিপছিপে, অবশ্যি শার্প, যা ফেলুদার সঙ্গে যায়। আর অভিনয়? পরমব্রত'র অভিনয়ের একটা নিজস্ব ধারা আছে। সেটাকে বদলে উনি কাউকেই নকল করতে যাননি, এই মঙ্গল। ফেলুদা চরিত্রটার সঙ্গে যে সতর্ক, চিন্তাশীল, সজাগ পর্যবেক্ষকের ভূমিকা যায়, যে খুড়তুতো ভাইয়ের উপর কিঞ্চিৎ স্নেহশীল, কিন্তু দুর্বল নয় অভিভাবকত্বে, সে সবটাই ফুটে উঠেছে।
তোপসের কেন গার্লফ্রেণ্ড থাকবে? সত্যজিৎ কোথাও উল্লেখ করেননি তোপসের মধ্যে একটা ‘গে’ হওয়ার সম্ভবনা আছে। অগত্যা তার গার্লফ্রেণ্ড আনাটা পুরোদস্তুর অন্যায় হয়েছে কি? শিল্পে অলঙ্করণ বলে একটা ব্যাপার থাকেই, তা যদি মূল টোনটাকে নষ্ট না করে।
অরিন্দম শীল যেটা দারুণ সফলতার সঙ্গে পেরেছেন সেটা হল ফেলুদার মূল টোনটাকে ধরে রাখা কয়েকটা নতুন সংযোজনের পরেও। যে সংযোজনটা, পরিবর্তনটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একজন সক্ষম আত্মবিশ্বাসী পরিচালক তার কাজে আনতেই পারেন। শার্লক হোমস তার সব চাইতে বড় উদাহরণ, কতভাবে কতরকম করে যে সেটা হয়েছে। সাবাশ ফেলুদার আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক, ক্যামেরার কাজ। ভীষণ স্মার্ট সিনেমাটোগ্রাফি। গল্পকে আঁকড়ে গল্পের মূলস্রোতকে নিয়ে ক্যামেরা সুন্দর এগিয়েছে।
সত্যি বলতে সিনেমাটার শিল্প হিসাবে সমালোচনা, আলোচনা না হয়ে অদ্ভুত এক ছুঁৎমার্গী ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-পরিহাস চলছে। অরিন্দম শীল মধ্যে মধ্যে ফেলুদার সিগনেচার টোন, বডি জেশ্চার, সংলাপ সবই এনেছেন, কিন্তু সে নকলের মত করে নয়, বরং যেন একটা ট্রিবিউটের মত করে। যে মানুষ বাকি সিনেমাটা এত বলিষ্ঠতার সঙ্গে পরিচালনা করতে পারেন একদম স্বকীয়তায়, তিনি যখন অন্য স্রষ্টার অংশকে ব্যবহার করেন, তখন তাকে শ্রদ্ধা জানানো বলে। নকল নয়। কারণ অরিন্দম শীল পরিচালক হিসাবে নিজেকে ফেলুদার সাহায্য ছাড়াই প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, এবং পরমব্রত, রুদ্রনীলও। সৌমিত্র ভাবতেই যেমন ফেলুদাকে ভাবতে হয় না, আরো অনেক চরিত্র ভিড় করে মাথায়, তেমনই পরমব্রতকে ভাবলেও শুধু ফেলুদাতে আটকে থাকে না স্মৃতি, অনেক সিনেমা মাথায় ভিড় করে আসে, পরমব্রত অনেক চরিত্র হয়ে ফিরে ফিরে আসেন। রুদ্রনীলের বেলাতেও তাই। রুদ্রনীলের মধ্যে জটায়ুর ছায়া আছে। সেটা পরিচালকের রসবোধের পরিচয়, অক্ষমতার নয়। পূর্বজকে শ্রদ্ধা জানানো মানে তাকে হুবহু নকল করা যদি হয়, তবে সে পন্থা দুর্বলের। সবলের শ্রদ্ধা জানানোর পন্থা অভিনব হবেই, সে ঘরানাকে ভেঙে এক নতুন পথ দেখাবে, নতুন রসের সৃষ্টি করবে। ফেলুদা কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র নয় যে সময়কে একটা জায়গায় আবদ্ধ রেখেই গল্প বলতে হবে। ফেলুদা একটা স্টাইল, একটা চরিত্র, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, নন-সেন্টিমেন্টাল, অবজেক্টিভ, কিন্তু বাঙালি হিসাবে অহংকারী, আত্মবিশ্বাসী। যারা মনে করেন নকলের পর নকল করে, দাগের উপর দাগ বুলিয়েই কোনো কাজকে টিকিয়ে রাখা যায়, তাদের উপর ভাবীকাল খুব একটা প্রসন্ন হন না। এই করে বহু সৃষ্টি কৃষ্টি বাঁচানোর চক্করে ইতিহাসের পাতায় হলুদ থেকে হলুদ হচ্ছেন, এবং তাদের সেই অচলায়তনের অনুরাগীরাও ইতিহাস হয়েছেন।
অরিন্দম বাবু ও পরমব্রত আপনাদের দু'জনকেই আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা, ফেলুদাকে ফেলুদার হাত থেকে রক্ষা করে আবার সজীব করে গড়ে তোলার জন্য।
বাঙালি কোনো পরিবর্তনকেই খুব সহজে স্বাগত জানায় না। সে শিল্প-সাহিত্য-সিনেমা হোক, কি রাজনীতি। একবার একটা ঘরানা তৈরি করলেই হল। দাগের পরে দাগ বুলিয়ে যাওয়া হয়। বাঙালি নস্ট্যালজিক এতে সমস্যা নয়, কিন্তু এটাই পুরো সত্য নয়, বাঙালি নস্ট্যালজিয়ায় অবসেসড্, এই অবসেসানটাই সমস্যার। তখন সে আর নিরপেক্ষ হয়ে বিচার করে না। সে শুধু পুরনো পুঁথি নামায়, তুলনা করে, পুরোনো পুঁথির ধুলোয় কিছুটা স্পষ্ট, কিছুটা অস্পষ্ট দেখে আর গালাগালের ঝড় তোলে। ভাবে যে কোনো ভাবেই দাগের উপর দাগ বুলিয়ে গেলেই সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল থাকা গেল। এ যে দুর্বলতার লক্ষণ সে ভেবেই দেখে না।
একটি চরিত্রই অপরিবর্তিত রেখেছেন অরিন্দম, সেটি হল সিধুজ্যাঠা। ফেলুদার চরিত্রে কোন পরিবর্তন না আনলে সিধুজ্যাঠার জায়গাতে যদি সারা গল্পটাকে স্থবির রাখতে হয়, তবে ফেলুদার গল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে কি?