গোঁসাই বাগানে বসে। ফুলের বাগান। একতারায় সুর ওঠে। গোঁসাই ডোবে, মাঝে মাঝে চোখ খুলে তাকায়। চারদিকে দেখে। আবার ডোবে।
গান থামল। তবু থামল না। একতারা পাশে রাখা। গোঁসাই গুনগুন করে চলেছে। যেন ভ্রমর বসেছে ফুলে। কি আনন্দের পরিবেশ চারদিকে। সবাই তন্ময়। কেউ কিছু ভাবছে না। ভাবনারা সব আলগা। কোথাও কোনো মন্দির নেই, দেবতার মূর্তি নেই। একটা চাতাল শুধু। সেই চাতালে বসে গোঁসাই।
- গোঁসাই, একটা প্রশ্ন আছে।
গোঁসাই ফিরে তাকালো।
- ভালোবাসা জন্মায় না কেন মনে?
- আনন্দ নেই বলে। আনন্দ থেকে ভালোবাসা জন্মায়। ভালোবাসা থেকে জ্ঞান। জ্ঞান থেকে আবার আনন্দ। এই হল মাধুরীর চাকা। ঘোরাও ঘোরাও...
- আনন্দ তো আছে।
- সে তো আছেই। গভীর ঘুমে মানুষ ডুবে যা পায়, সেই আনন্দ। সেখানে না ক্ষোভ, না ঈর্ষা, না বাসনা। আবার স্বপ্নের জগতে ভাসে। সেখানে তার মন একটা জগত তৈরি করে নিয়ে আবার তাকে ঘোরায়। ঈর্ষা, বাসনা, ক্ষোভ, রাগ আরো কত কি! জেগে গেলে সেই স্বপ্ন দেখানো মন আবার এই জগতে তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায় - এটা চাই, সেটা চাই, এ হব, সে হব। একে এক হাত নেব, ওকে আরেক হাত নেব। একে পাব। ওকে দেখব। কত কি! এই পাওয়া খানিক সুখ, আবার ফিরে দুঃখ কি বিষাদ! এতে আনন্দ কই?
- তবে আনন্দ আসে কি করে?
- আনন্দই আনন্দকে টানে। এই যে গান শুনছিলে, জগতচিন্তা ছিল?
- না।
- নিজের চিন্তা?
- না। এই আনন্দ তবে?
- না, এ হল আনন্দের আবেশ।
- তবে আনন্দ পাই কি করে?
- আনন্দই আনন্দকে টানে। যখন সে টানে সাড়া দেবে তখনই আনন্দ।
- সাড়া দিই না?
- দাও কই! মত্ত থাকো তো নিজের ঘোরে। সে ডাক এসে রাতদিন ফিরে ফিরে যায় তাই!
- এত কর্তব্য, এত কাজ, এত দায়িত্ব...
- আনন্দে না থাকলে সব বোঝা.... শুধু বোঝা... এতে কোনো মঙ্গল নেই.... যার আনন্দ নেই তার ভালোবাসাও আসক্তি... যাকে ভালোবাসে আর যে ভালোবাসে দু'জনের প্রাণই ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে তাই ক'দিনেই.... দু'জনেই পালাবার পথ খোঁজে...
- আনন্দের টান আসে কোত্থেকে....
- মনের দরজা খুলে দাও, সে টান ফুলের রঙে, গানে, রান্নায়, বাচ্চার হাসিতে, আকাশে, বাতাসে.... কোথায় নেই... সর্বত্র.... ভালো করে ভেবে দেখো তো এই পৃথিবীর সমস্ত আনন্দকে মাটি করছে কে? আমাদের লোভ। আবার আমরাই পাহাড় নদী নির্জনতা খুঁজে বাঁচতে পালাচ্ছি... আমরা আমাদের হাত থেকেই যেন পালিয়ে বাঁচতে চাইছি. সব সুখ, সব বিলাসিতা কেন হঠাৎ ফাঁসের মত লাগে গলায়? আনন্দ নেই বলে... মানুষ বাঁচে আনন্দে... বাকি সব রোগ... মহারোগ... ভববিকার....
- সে আনন্দ তোমাকে দেখলেই প্রাণে জন্মায় গোঁসাই....
- সে তোমার প্রাণের গোঁসাই আমায় দেখলে নিজেকে চিনতে পারে বলে... নইলে আমায় দেখেই বা কি পাও.... বরং হারাও...
- কি হারাই?
- বাহ্যজগৎ... সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভিতরের ঢাকনা যায় খুলে... তাই যা পাও তা হল....
- আনন্দের আবেশ....
- হ্যাঁ... সাড়া দাও... সাড়া দাও...