Skip to main content

কথা বলা দায় জানো। কথা বললেই সুর খোঁজো, চড়া না নরম। কথা বললেই রঙ খোঁজো, গেরুয়া না সবুজ না লাল। এভাবে কথা বলা যায়?

      মানুষ বলতে তুমি কি বোঝো আমি জানি না। সত্যি বলতে আমিও জানি না। ডাক্তারের কাছে গেলে নিজেকে লিভার, কিডনি, হার্ট, জীবাণুর গোপনঘাঁটি এইসব মনে হয়। ধর্মীয় আলোচনায় গেলে নিজেকে শরীরের বাইরে অলীক কিছু মনে হয়। নেতাদের কথা শুনলে নিজেকে কেমন বোকা অসহায় আলুর বস্তা মনে হয়। প্রেমের কাছে এলে নিজের হাজার একটা অক্ষমতা পিঁপড়ের সারির মত এখানে ওখানে জটলা পাকিয়ে থাকে। একমাত্র কমোডে বসে থাকি যখন নিজেকে নিজে মনে হয়। যেন বাইরের হাততালির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, সে অন্য কারোর জন্য পড়ছে, আমার টার্ন এখন না। এখন আমার সাময়িক বিরতি।

      উদাস হয়ে যাই। আর উপায় নেই তো। এতবড় সমাজ, এত জটিল বুনট। কতটা বুঝি তার? খুব জোর দিয়ে যখন কোনো কথা বলি, মনে মনে বেশ জানি, এ আবেগের জোর। সত্যের জোর নেই। কারণ সত্য একটা অ্যাঙ্গেল। দক্ষিণ দিকে যা স্পষ্ট, উত্তর দিক থেকে হয় তো সেটা নেই। বা আছে, অন্যরকম। তাই মাঝে মাঝে উদাসীনতার বিরাম নিই। মনের সামনে পুকুর। পুকুরের জলে অসংখ্য মাছ। আমি পাড়ে বসে। আমার পাশে ছিপ, চারা। কিন্তু আমি মাছ ধরব না। একেই উদাসীনতা বলে।

      আমি বিরাম নিচ্ছি মাঝে মাঝে। উদাসীন হয়ে পানকৌড়ির মত ডালে বসে আছি। ঈশ্বর সামনে দিয়ে চলে গেলেও ডাকব না। আমার দিকে তাকালে বলব, আপনি যান, আমার কিছু বলার নেই আপনাকে, আমি জানি আপনি সুখী নন।

      আজকাল হাওয়াকেও বিশ্বাস হচ্ছে না। আকাশের নীলরঙকেও না। মাটির সরলতাও যেন কপটতা। কি গভীর ষড়যন্ত্র চারদিকে। এরকম আগে ভাবতাম কিনা জিজ্ঞাসা করছেন? না, ছিলাম না তো। আগে আমি জানতাম আমি যা জানি তাই ঠিক। এখন আমার কেমন জানি মনে হয়, আমি যা জানি না সেইটাই যেন বেশি সত্যি, যা জানি তার চেয়ে।

      এইতে আমার আত্মবিশ্বাস কমেছে ভাবছেন? ভুল ভাবছেন। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে অনেক। কি করে বললাম? কারণ আছে। মানুষ রঙ পাল্টালে অবাক হই না আগের মত। মানুষের বগলে লুকানো নানা মতলবের লিস্ট দেখে ভুরু কুঁচকাই না আর। কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করল বলে রাতের ঘুম নষ্ট করি না আর। মা বলতেন বালিশে ভগবানের নাম লিখে শুলে রাতে ভয় করে না। আমি বালিশে ঈশ্বরের নাম লিখে শুলে ঈশ্বর ভয় পায়, আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ঘুমাস না, চারদিকে এ কিসের শব্দ? আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলি আমার স্বপ্নরা হাঁটছে।

      অতএব আমার আত্মবিশ্বাস অনেক এখন। যারা সারা বছর খোঁজ না নিয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানে সঙ সাজতে ডাকে, তাদের মুখের উপর বলে দিই, যাব না। যারা ভালোবাসার নাম করে জিলিপির ফাঁদ পাতে, তাদের বলি রাস্তা দেখো, মাফ করো। যারা এদিক ওদিক সবদিক রেখে বলে, আসলে ওরা ভালো না, তুমি ভালো, তাদের বলি, তুমি জানো না তোমার পিছনে আরেকটা আয়না আছে, সেখানে তোমার পাছায় তোমার আরেক মুখের ছবি। সে মুখের ভাষাও আমি পড়তে জানি।

      আমি ভালো না। তুমিও ভালো না। আমরা আসলে কেউ ভালো না। স্পষ্ট বললে তুমি বলবে আমি নামি সিনিক। ফেনিয়ে বললে, বলবে আমি নাকি স্কেপটিক। আসলে স্পষ্ট বলবে না যে আমিও ভালো না, আর তুমিও ভালো না। তবে এটা এখন স্পষ্ট করে বলার সময় এসে গেছে। বেঁচে থাকাটা শখ না আবশ্যক কেউ কেউ না বুঝে ধুম করে আত্মহত্যা করে ফেলে। সে যে কেউ করতেই পারে। সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল এইটা স্বীকার করে নেওয়া, আসলে ভালো বলতে আমরা যা বুঝি সেরকম কিছু হয় না। হত যদি তবে পৃথিবীটা অন্যরকম হত। তার মানে কি সবাই খারাপ? ধুস! তাই বললাম নাকি? তাও না। খারাপকে খারাপ বলার মত ভালোও আমি নই। আমি বলি সব গোলমেলে, অ্যাবসার্ড। উদ্ভট।