এ কদিন যতবার রাস্তায় বেরোলাম চোখে পড়ল শুধু পুলিশ, পুলিশ আর পুলিশ। কলকাতায় যেমন চোখে পড়ল, তেমনই কালনা থেকে ফেরার সময় বিভিন্ন মণ্ডপের সামনে চোখে পড়ল পুলিশ আর পুলিশ।
আমাদের নিন্দার দিকে ঝোঁক বেশি থাকে। সে আমাদের জন্মগত অধিকার। কিন্তু নিন্দা প্রশংসার বাইরেও কিছু থাকে, দায়িত্ব। আরো ভালো করে বললে, বলতে চাইছি থ্যাংক্সলেস দায়িত্ব। একটা কথা শুনি প্রায়ই, সবাই সব কিছু টাকার জন্য করছে। যিনি বর্ডারে লড়ছেন, যিনি প্রতিদিন বিচারকের আসনে বসছেন, যিনি হাসপাতালে ঢুকছেন স্টেথো ঝুলিয়ে, যিনি ট্রেনের চালকের আসনে ইত্যাদি ইত্যাদি…।
অবশ্যই অর্থের সংযোগ আছে। কিন্তু সেটাকেই প্রধান করে দেখার মধ্যে শুধুই একটা সংকীর্ণ দৃষ্টির প্রশ্রয় আছে। মানুষের মনের তত্ত্ব অত সরলরৈখিক নয়, একমাত্রিক নয়। যে কাজটা করে যাচ্ছি তার উপর শ্রদ্ধা না থাকলে, একটা আন্তরিক দায়িত্ববোধ না জন্মালে সে কাজ দিনের পর দিন সুচারুভাবে করে যাওয়া এক প্রকার অসম্ভব। যত টাকাই মাইনে হোক না কেন, কাজের জায়গায় সে মানুষ ব্যর্থ হবে। সেই প্রফেশানে সে শুধুই লজ্জার কারণ হবে। এমন উদাহরণ নেই বলছি না, কিন্তু শুধু তাদের দিয়েই সমস্ত ডিপার্টমেন্ট চলছে, এ শুধু অতিকথন না, সে নিজেরও বোধেরও চূড়ান্ত দৈন্যের প্রমাণ।
চোয়াল শক্ত, হাতে লাঠি, ফোন, ওয়াকিটকি…. সামলিয়ে যাচ্ছেন জনসমুদ্র। যে জনতা আদৌ শৃঙ্খলাবদ্ধ নয়, যে জনতায় প্রায় সবাই চাইছে আগে যেতে, কি অমানুষী প্রতিদ্বন্দ্বিতা। জনতায়, গাড়িতে মিলে রাস্তার দখল নেওয়ার কি উগ্র তাণ্ডব। একজন বৃদ্ধকে ভিড়ের মধ্যে লাঠিটা এগিয়ে দিয়ে রাস্তা পার করে আনা, একজন শিশু কোলে মা'কে লাঠির আড়াল টেনে লাইনে জায়গা করে দেওয়া… এরকম অজস্র উদাহরণ আছে। আমি যে তাণ্ডবকে দশ পনেরো মিনিটে পার হয়ে এলাম, তারা সেই তাণ্ডবকে ঘন্টার পর ঘন্টা কি অসীম ধৈর্য্যের সঙ্গে সামলে যাচ্ছেন, রোদ-জল-গরম সব সহ্য করে। হাজার মানুষের বিরক্তি, রাগ সব কিছুকে সহ্য করে, হজম করেও। আমরা প্রত্যেকেই সব জায়গায় শৃঙ্খলা চাইলেও আমাদেরই আরেক অংশ লাইনে অন্যের পিছনে দাঁড়ানো, আরেক গাড়ির পিছনে যাওয়া, সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা ইত্যাদিকে খুব একটা সুনজরে, ভালোভাবে দেখে না। সময় নষ্ট ভাবে, নয়তো আণ্ডার প্রিভিলেজড ভাবে। সে চায় ওভারটেক করে এগিয়ে যেতে। লাল সিগন্যালটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে। ফলে কি হয়? চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। যদিও আমরা প্রত্যেকে শান্তি চাই। যে শান্তির কাজের জগতে নাম হল শৃঙ্খলা।
তা বলে এত বড় কর্মযজ্ঞে কারোর কোনো অভিযোগ কি নেই? অবশ্যই থাকবে। কিন্তু সমস্যাটা কি হয়, অভিযোগ যখন ক্ষোভে রূপান্তরিত হয় তখন সে বাস্তব দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে। একের দোষকে সকলের দোষ হিসাবে দেখে। আমার একবার চোখে spk নামে কি এক ব্যামো হয়েছিল, আমি প্রায় দেড়মাস সব ঝাপসা দেখেছিলাম বাঁ চোখে। ক্ষোভ এমনই জিনিস। ম্যাগনিফায়িং করার ক্ষমতা তার এত বেশি, সে একের দোষকে সমগ্রের দোষ হিসাবে বিশ্বাস করতে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ করে না।
দরদ এক মহার্ঘ্য বস্তু। কিন্তু যখন কাউকে গ্র্যাণ্টেড ধরে নিই আমরা তখন যেটা সবার আগে তার উপর চলে যায় সেটা হল দরদ! তখন শুষ্ক তাত্ত্বিক অবাস্তব মানদণ্ডে তার কাছ থেকে নিখুঁত সব কিছু আশা করি, যা এই রক্তমাংসের শরীরে অসম্ভব। এরা আমাদের ভিড় সামলাবেন বলেই তো জন্মাননি। এদের অনেকের পরিবার আছে। বাচ্চা আছে। তারাও অপেক্ষা করে থাকে বাবা কি মা কি দাদা বা দিদির জন্য। বাড়ি ফিরবে, বেড়াতে যাবে একসঙ্গে কি হুল্লোড় করবে একসঙ্গে বাড়িতে। কি না হয় পাড়ার মণ্ডপেই বসবে। কিন্তু সে সব ছেড়ে তারা যে অসীম ধৈর্য্যের সঙ্গে প্রতি বছর এই আকাশে বাতাসে ঘোরা ছুটির আমেজ উপেক্ষা করে কঠিন দায়িত্বে থাকেন, এ অনেক বড় একটা কথা। ওনারা আছেন বলেই পুজোটা এমন সুষ্ঠুভাবে হয়। আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও নমস্কার জানাই তাদের, যাদের ওই ভিড়ের মধ্যে বলতে পারিনি, থ্যাংক ইউ। আর শুভ বিজয়াও জানাই তাদেরই প্রথম যারা চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলতাকে সামলিয়ে এক সুষ্ঠু পুজো আমাদের দিয়েছেন, আসল বিজয় তো সেটাই।