Skip to main content

আমার বগল ঘামছে। এসি অন। হাতের মুঠোটা শক্ত করে আছি। এটা রিফ্লেক্স অ্যাক্সন। টেনশান হলেই আমার হয়। ট্রেনটা মিস হবে। যশোবন্তপুর এক্সপ্রেস। ছাড়তে আর আধঘন্টা বাকি। কিন্তু যা জ্যাম, অসম্ভব। ফোন সুইচ অফ্ করে দিয়েছি। রেড্ডী অনেকক্ষণ ঢুকে গেছে স্টেশানে, আমি তখন বেলঘরিয়া ছাড়ছি। হাওড়া স্টেশানের পাশেই একটা হোটেলে ছিল। মনে হচ্ছে না পাবো। এমন জ্যাম যে আমি দরজাটাও খুলতে পারব না কোনোদিকে। দাদা, এসিটা একটু বাড়ান না…

    বাড়বে না। আর আপনি ট্রেনও পাবেন না। একটা লরি উল্টেছে হাওড়া ব্রীজে ওঠার আগেই। কোম্পানি থেকে ফ্লাইটের টিকিট পাঠিয়ে দেবে... যদিও আপনার ফ্লাইং বারণ, তবু আজ আপনাকে রিস্ক নিতেই হবে, কারণ কোম্পানি কয়েক কোটি টাকা লসে যাবে না হলে... যদিও আপনার ফ্লাইট কাল পাবেন, মিটিং পরশু সন্ধ্যেতে তো। আর রেড্ডী এতক্ষণে হোটেলে পৌঁছে গেছে। চাইলে ফোন অন্ করতেও পারেন, নাও পারেন।

    আমার মাথা ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেল, “আমি কি কিডন্যাপড?”

    এখনও অবধি না। আমরা ওসব করি না। আমাদের কাজ হল লাশ গুম করা। আপনার ঠিক পিছনে, মানে পিছনের ডিকিতে একটা উনিশ বছরের মেয়ের লাশ আছে। আজ আমার এটাই লাস্ট ডিউটি। সাধারণ আমরা দিনে দুটোর বেশি কেস নিই না। তবে এক একদিন চারটেও হয়ে যায়।

    আপনি কি নেশা করে আছেন?

    কোনো উত্তর নেই।

    মানে আপনি যা বলছেন সব সত্যি?

    একটাও ভুল তথ্য দিলাম আপনার সম্বন্ধে?

    আপনি বাঙালি নন। আপনার উচ্চারণে একটা উত্তর ভারতের হিন্দী বলয়ের টান আছে।

    কোনো উত্তর নেই।

    এত কিছু জানলেন কিভাবে?

    আমাদের নেটওয়ার্ক আছে। আমার গাড়িতে এমন কিছু করা আছে যে আপনি কি কি নিয়ে উঠেছেন সে সব মুহূর্তেই আমাদের হেড অফিসে স্ক্যান হয়ে চলে যায়। এ সব আমাদের সেফটির জন্য আমাদের করতে হয়।

    কিন্তু আপনি এসব আমায় বলছেন কেন? মানে আপনি ভিতরে যাই করুন না কেন, বাইরে তো আপনি একজন ট্যাক্সি চালকের কাজ করেন, মানে দেখান আর কি। তো নিশ্চয়ই সব যাত্রীদের বলেন না, তবে আমায় কেন?

    আজ আমার মনটা খারাপ। একজন ক্রিমিনাল হতে গেলে সব চাইতে আগে কি শিখতে হয় জানেন, আত্মনিয়ন্ত্রণ। আজ আমার সেই পার্টসটা কাজ করছে না। আজ আমি ইমোশনাল, একটু বেশি ইমোশনাল। এটা বাজে লক্ষণ। তাই কথা বলতে ইচ্ছা করছে। এই যে ট্রেনটা আজ আপনার মিস হল এটা হয় তো আপনার জন্য ভালো হল না।

    মানে?

    মানে আমার মনে হলে আজ আপনাকে সরিয়েও দিতে পারি।

    আমার মনে হচ্ছে আমি যেন একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে আছি। তবু আমি অদ্ভুত রকমের শান্ত। কি করে? আমার বুদ্ধি এখনও কাজ করছে। আমি সব স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আমার সঙ্গে কি কি হতে পারে জেনেও শান্ত আছি কি করে? ডাক্তার বলেছিল, আমার মধ্যে নাকি মিডলাইফ ক্রাইসিস শুরু হয়েছে। আমার এখন বয়েস একান্ন। এই মিডলাইফ ক্রাইসিসে কারোর মধ্যে একটা ইউথড্রয়াল, ডিসকানেক্টেড লক্ষণ দেখা যায়। সেই জন্যেই কি আমি এত শান্ত? আমার বাঁদিকে একটা বাস। ভর্তি অফিস ফেরত যাত্রী। ক্লান্ত, বিষণ্ণ। আমার ডানদিকে একটা প্রাইভেট কার। একজন মহিলা চালকের আসনে। দরজাটা খুলে পালাব?

    আপনি দরজা খুলতে পারবেন না, আমি না চাইলে। আর বাইরে যাদের দেখছেন, তারা আপনাকে দেখতে পাচ্ছে না। কাঁচে প্রজেক্ট করা আছে অন্য ছবি। তারা দেখছে একজন বয়স্ক মানুষ ঘুমাচ্ছেন।

    এর আগে আপনি কোনো ইনোসেন্ট যাত্রীকে মেরেছেন?

    না। দরকার পড়েনি। আজ পড়লেও পড়তে পারে।

    কেন? ও আজকে আপনার আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই, তাই?

    হুম। ক্রিমিনাল হতে গেলে দুটো জিনিস থাকতেই হয়, আর একটা জিনিস থাকলে চলে না। বার্ট্রান্ড রাসেল পড়েছেন?

    একটা…

    কনকুয়েস্ট অব হ্যাপিনেস... তাই তো?

    কিভাবে জানলেন?

    সাধারণত অ্যাভারেজ আই কিউ-এর লোকেরা ওই একটা বই-ই পড়ে থাকে রাসেলের... সেটা ইস্যু না... আপনি নিজেও জানেন আপনি একজন অ্যাভারেজ মস্তিষ্কের লোক... তাই আপনাকে হত্যা করতে আমার খুব একটা এথিক্সে লাগবে না…

    এথিক্স?... হাসলাম…

    ওই যে বললাম, অ্যাভারেজ ব্রেন আপনার... তাই এথিক্স আর মর‍্যালিটির মধ্যে পার্থক্যটা ধরতে পারলেন না... সব বিজনেসের মধ্যেই একটা এথিকাল সাইড থাকে…

    জানি…

    জানি... কেতাবি বিদ্যায় জানেন... তো যেটা বলছিলাম… রাসেল বলছেন একজন সভ্য মানুষ হতে গেলে তিনটে জিনিস দরকার - আত্মনিয়ন্ত্রণ। বুদ্ধিমত্তা। অনুকম্পা। একজন ক্রিমিনাল হতে গেলে প্রথম দুটো লাগে, শেষটা রাখতে নেই।

    সেটা থাকলে আর একাজে আসবেন কেন?… আশ্চর্য। আমার ভয় করছেন না। এত স্পষ্ট চিন্তা আমি শেষ কবে করেছি বলে মনেই পড়ছে না... অথচ জানি কালকের সকালটা আমার জন্য নয়... আমার লাশের…

    ঠিক। আমাদের মধ্যে ওই ট্রেটসটা নেই।

    সহানুভূতি একটা ট্রেটস?

    অবশ্যই... সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি... প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে একটা ক্রিমিনাল থাকে। অ্যাভারেজ মানুষ জানে যে কোনো ক্রাইমে জড়িয়ে পড়লে সোস্যাইটির প্রিভিলেজগুলো থেকে নিজেকে ডিপ্রাইভড হতে হবে। তাই একটা কম্প্রোমাইজের রাস্তায় হাঁটে মানুষ। চাকরি - এই শব্দটা জন্মায় সেখান থেকেই। এ লো সেলফ এস্টিম ক্রিমিনাল, ইন এ কম্প্রোমাইজড স্টেট, টু এনজয় রেডিমেড সোস্যাল প্রিভিলেজ, দ্যটস অল... অ্যণ্ড জব ইজ দ্যাট পিভট। আপনারাই হলেন কমোন ম্যান।

    আপনি একজন সাইকোপ্যাথ…

    হতে পারি, সেটা প্রমান সাপেক্ষ। তবে আপনি নিজেকে দেখে অবাক হচ্ছেন না? একটা নির্মম পরিণতি আপনার হতে পারে জেনেও আপনি কেমন স্থির স্বাভাবিক হয়ে আছেন?

    সেটা লাগছে, অস্বীকার করি না…

    কেন লাগছে জানেন? কারণ এই মুহুর্তে আপনার মধ্যে কোনো ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স কাজ করছে না... আপনার নিজেকে অনেক ভারমুক্ত লাগছে... আপনি নিজের সামনে নিজে উলঙ্গ এখন... তাই ভয় নেই... এখানে সমাজ নেই... তাই আপনার মধ্যে কোনো ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সও নেই... সারাটা জীবন আপনাদের মত মানুষ যেটা সাফার করেন... আর নিজেদেরকে তোষণ করেন নানারকমের ব্রুটাল ওয়েব সিরিজে... এ ক্রিমিনাল মাইন্ডস ইনোসেন্ট মাস্টারবেশান... ঠিক বলিনি? চিনতে পারছেন নিজেকে অরুণাভ বসু? বাঁ দিকে তাকান... বাস দেখতে পাচ্ছেন? এবার দেখুন…

    বাসটার দিকে তাকালাম। মুহূর্তে একটা বিরাট বিস্ফোরণ হয়ে বাসটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল... আমি শিউরে উঠে ডানদিকে ছিটকে এলাম…

    যা দেখছেন এটাও প্রজেকশান... এইবার দেখুন…

    অক্ষত বাসটা দাঁড়িয়ে…

    কি? এঞ্জয় করলেন?

    না

    অথচ এই দৃশ্য কতবার এঞ্জয় করেছেন সিনেমার পর্দায়... ডান দিকে তাকান…

    প্রাইভেট কারের মহিলা... একজন পুরুষের সঙ্গে সঙ্গমরত... আমাদের গাড়ির মধ্যে তার সীৎকারের আওয়াজ আসছে... মহিলার হাত পা বাঁধা... চোখটাও…

    এই দৃশ্যও এঞ্জয় করেছেন না? এখনও সেনসেসান হচ্ছে... সামনে যম দাঁড়িয়ে জেনেও হচ্ছে... হবে, ওটা বহু শতাব্দীর জান্তব অভ্যাস... মাস্টারবেট করবেন?... আমি দৃশ্যটা কন্টিনিউ করাতে পারি... চাইলে আরো র…

    না থাক... মেয়েটা কে?

    ডিকিতে?

    হ্যাঁ… আপনার পরিচিত?

    আমার মেয়ে... জেনে ফেলেছিল বাবার কাজের কিছু কথা... সরিয়ে দিতে হল তাই... ওইজন্যেই আজ একটু ইমোশনাল... আত্মনিয়ন্ত্রণ কম্প্রোমাইজড... বাট ইট ডাস নট ম্যাটার... আই অ্যাম নট দ্যাট স্টুপিড... নট এন ইমোশনাল ফুল... আত্মায় বিশ্বাস করেন?

    জানি না…

    আমি করি... ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্... নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ... অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো... ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে... শুনেছেন?

    হ্যাঁ জানি... আত্মার জন্মমৃত্যু নেই... সে কাউকে হত্যা করে না... নিজেও হত হয় না... বোগাস অল দিস…

    জানি আপনার বোগাস লাগবে। কারণ আপনার মস্তিষ্ক অ্যাভারেজ। কল্পনা করার শক্তি কম। তাই আপনারা সুবিধাবাদী নাস্তিক। আসলে আপনারা আস্তিক নাস্তিক কিছুই নন... জাস্ট অ্যাভারেজ ক্রিয়েচার…

    মানে আপনি বলতে চান সমস্ত বুদ্ধিমানেরা... মানে আপনার ভাষায় হাই লেভেল ইন্টেলেকচ্যুয়ালরা সবাই আস্তিক…?

    দেখলেন, আপনার কথায় একটা ব্যাঙ্গের সুর আছে? ওটাও অ্যাভারেজ ব্রেনের লক্ষণ... যা হোক... ঠিক তাই... আসলে আপনাদের কাছে আস্তিক বা নাস্তিক মানে হল একটা প্রতিষ্ঠিত আইডিয়াকে আইদার অস্বীকার করা, বা স্বীকার করা... তাও নিজের সুবিধা অনুযায়ী... নট ইন এ ভেরি পিউর ইন্টেলেকচ্যুয়াল আনবায়সড ওয়ে... বাট ইন এ ভেরি মাচ সেলফ ইন্টারেস্ট কারাপ্টেড ওয়ে... কিন্তু আমরা একটা আইডিয়াকে কনসিভ করি। নীৎজেও সেই অর্থে একজন আস্তিক। যিনি গড ইজ ডেড বলার সাহস রাখেন... তিনিও সেই আইডিয়াটাকে কনসিভ করেন... একটা আইডিয়াকে কনসিভ করা, সেই আইডিয়াটায় বাঁচা আপনাদের মত অ্যাভারেজ ব্রেনের কাজ নয় মশায়... আপনারা খুচরো ব্যবসায়ী... এর ওর মাল কেনেন আর বেচেন…

    সো হোয়াট নেক্সট... ইজ দ্য ফাকিং জ্যাম রিয়েল অর নট... ইউ মাদার ফাকার…

    ওয়েব সিরিজের গালাগাল... ভালো... দেখুন আপনারা অ্যাভারেজরা একটা গালাগালও আবিষ্কার করতে পারেন না... ইউ অল আর ইভেন এ প্রে অব গালাগাল ইম্পেরিয়ালিজম... ইসন্ট ইট!... বাই দ্যা ওয়ে... দ্যা জ্যাম ইজ রিয়েল স্যার... বাট ইউ হ্যাভ মিসড দ্য ট্রেন…

    সো ইউ আর গোয়িং টু…

    ওয়েট ওয়েট স্যার... অ্যাভারেজ ব্রেন সব চাইতে তুষ্ট হয় কিসে বলুন তো? তোষামোদিতে... ইন আদার ওয়ে বার খেতে... আপনাকে মরতে হবে না…

    তবে?

    আমি কিছু বোঝার আগেই আমার থাইয়ে ভীষণ সুক্ষ্ম কিছু একটা ঢুকে গেল মনে হল... প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে…

    ওটা একটা ইঞ্জেকশান স্যার... বিগত আড়াই ঘন্টা আপনার স্মৃতি থেকে ঝাপসা হয়ে যাবে। আপনি আর সাড়ে তিন মিনিটেই ঘুমিয়ে পড়বেন। আমি আপনাকে রথতলার মোড়ে শুইয়ে দিয়ে চলে যাব, ভয় নেই ওখানে যে মঞ্চটা আছে ওর সামনে একটা ফাঁকা জায়গা আছে। বারো ঘন্টা ঘুম হবে। কাল মাথাটা অল্প ঝিম ঝিম করবে... সকালে উঠে... স্যার শুনতে পাচ্ছেন... স্যার...