দু'দিন আগেও বাগানে ঘুরে গেছেন, সবাই বলল। পুকুুনের মা জানত, মাথাটা গরম হলেই বাগানে ঘোরেন। একা একা ঘোরেন। একা একা কথা বলেন। একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে মাটিতে শুয়ে থাকেন। সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবী গায়ে রোগা মানুষটা সারা বাগানে ফুল তুলতে তুলতে গান গাইত। একা একা গান গাইত। একা একা খেত। একা একা শুতে যেত। একা একা ঘুম থেকে উঠত। একা একা চায়ের জল চাপাত। এটা বাড়ির দোতলার গল্প। নীচের তলায় অন্য ভায়েদের ভরা সংসার। কত ভাইপো, ভাইঝি, দাসদাসী, আত্মীয়পরিজন, প্রতিবেশীদের ভিড়। তাদের গলার আওয়াজ আসে দোতলায়, তারা কেউ আসে না।
মানুষটা একা একাই মারা গেল। মারা যাওয়ার সময় তার পাশে কেউ ছিল না। মাত্র কয়েকদিনের জ্বরেই চলে গেল। বয়েস হয়েছিল বাষট্টি।
পুকুনের মা'র সকাল থেকে ঘাড়ে যন্ত্রণা, জ্বর জ্বর। পুকুনের মায়ের একটা ছোট্ট গল্প আছে। পুকুনের মায়ের বাড়ি বনগাঁ। বিয়ে হয়ে আসে এই কাঁচরাপাড়ায়। তার বর একটা মিলে কাজ করে, তেমন রোজগার নেই। তখন এই সেন বাড়িতে পুকুনের মা কাজে আসে, প্রথম কাজ। তখন সে পুকুনের মা কই, সে তখন শুধুই মায়া, মায়া গড়াই। মায়ার এক দাদা আছে বনগাঁতে, পোলিওতে হাঁটতে চলতে পারে না। তার সব দাদার বিয়ে হলেও, সেই বড়দার বিয়ে হয়নি। কে করবে বিয়ে অমন পঙ্গুকে! মায়ার মা মারা গেল সাপে কেটে। বাবা মাতাল। ভাইগুলো মানুষ না, তা সেই দাদা, মানে হরিশের ভার নিল মায়া। সে সেলাই জানত, বিড়ি বাঁধতে জানত, সেই থেকেই সে কিছু কিছু করে দাদার নামে সঞ্চয় করে রেখে এসেছিল। কুড়ি হাজার মত হতে না হতেই তার বিয়ে হয়ে গেল। কাঁচরাপাড়ায় এসে তার কাজ ধরার মুখ্য কারণই ছিল তার দাদা। বিশুদা সেটা বুঝেছিল। বিশু সেন। হাইস্কুলের অকৃতদার মাষ্টার। তাকেই দাদা পাতালো মায়া, আসলে তার মধ্যে একটা নিজের দাদার ছাপ দেখেছিল মায়া। মায়ার বর বিকাশও বুঝেছিল, সে কিছু বলত না, বলত ঠিকই আছে, না হয় ক'টা টাকা পাঠালেই দাদাকে, উনি তো কিছু করেন না। বিকাশ একবার তার বড় শালাকে নিয়েও আসতে চেয়েছিল, হরিশ আসে নি।
মায়া কিছু টাকা নিজের জন্য রেখে বাকিটা দাদার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিত। তবে বেশিদিন পাঠাতে হল না, কোনো এক ঝামেলায় হরিশ বিষ খেল। মায়া বনগাঁ পৌঁছিয়ে, বাকি ভাইদের সাথে তুমুল অশান্তি করে সব সম্পর্ক একেবারে চুকিয়ে ফিরে এলো। এই ঘটনার দু'বছরের মাথায় পুকুন হল, মায়া ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেন বাড়ির কাজ ছাড়ল। আরো অন্যান্য বাড়ির কাজ নিল কয়েকটা। সেন বাড়ির কাজ ছাড়ত না, কিন্তু ওই বাড়ির ছোটোভাইটা তার পিছনে পড়েছিল, বিকাশ সব শুনে বলল, কাজ ছেড়ে দাও। তাই করল মায়া।
আজ সকালে সে কাজে বেরোবে, শরীরটা ভালো নেই যদিও, শুনল বিশু সেন মারা গেছে। আজ মায়া পুকুনের মা। একবার ভাবল যাবে না। তারপর কি মনে হল, গেল। বাড়ির দিকে যেতে যেতে কান্নার আওয়াজ কানে আসতে লাগল। তার হরিশের মুখটা মনে পড়ল। তার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা মনে পড়ল। তাকে ভাত মেখে নিজের হাতে করে খাওয়ানো মনে পড়ল। তার জ্বরের সময় মাথায় জলপট্টি দেওয়া মনে পড়ল। কখন সে বিশু সেনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। খাটে শোয়ানো। মায়া দেখল, কপালে চন্দন নেই। সে বাড়ির ছোটো বউদিকে বলল, আমায় একটু চন্দন বেটে দেবে দিদি, কপালে দিই দাদার, বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
চন্দন বাটা এলো, সাথে একটা দেশলাই কাঠি। মায়া বাবু হয়ে বসে কপালে হাত ছোঁয়ালো, হিম ঠাণ্ডা। কয়েকদিন আগেই নাকি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। বাড়ির ছোটো মেয়েটা এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, "তুমি আগে এলেনা কেন পিসি, জ্যেঠা তোমার হাতের রুটি খেতে চাইছিল বেগুনভাজা দিয়ে।"
মায়ার এতক্ষণ কান্নার কথা মনে ছিল না, সে হরিশের চিন্তায় ডুবেছিল। হঠাৎ এই কথাটা শুনে মায়ার যেন সম্বিৎ ফিরল, তার তো বুকটা পাথর হয়ে আছে কান্নায়। কিন্তু মনটা হঠাৎ দমে গেল, কান্নার বেগটা একটা বড় পাথরে এসে যেন থমকে দাঁড়ালো। সে এই বাড়ির দাদাকে হরিশের ছায়া ছাড়া তো কিচ্ছু ভাবেনি কোনোদিন। নিজের দাদার অভাবটাই মিটিয়ে নিয়েছে শুধু, তার বেশি কি দিয়েছে সে মানুষটাকে, এতো চূড়ান্ত স্বার্থপরতা তার! সে থমকে গিয়ে বিশু সেনের বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। চন্দনের বাটিটা মাটিতে রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল, বউদিকে বলল, দিদি তুমি ওদের একটু দাঁড়াতে বলো, আমি দুটো রুটি আর বেগুন ভাজা এখনই করে নিয়ে আসছি। কথাটা এতটাই অস্ফুটে বলল, কারোর কানে গেল না। সে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে গেল। তার আঁচল মাটিতে লুটালো। তার ক্ষয়ে যাওয়া হাওয়াই চটিটা সেন বাড়ির উঠোনে পড়ে রইল। বাড়িতে আটা মাখা ছিল। পুকুনের স্কুলের টিফিন হবে। সে তাড়াতাড়ি রুটি বেলতে বসল। গোল হল না ঠিক, তবে হল কিছু একটা। দুটো বেগুন কাটল, সাথে আঙুলও। যখন সে একটা খবরের কাগজে মুড়ে দুটো রুটি আর বেগুনভাজা নিয়ে সেন বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালো, তখন ওরা শ্মশানের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে। উঠোনে কয়েকটা খই, তার ফেলে রাখা চন্দনের বাটি আর তার চটিটা ছাড়া কিছুই ছিল না।