“কীর্তন দেওয়া যায় নারে ভাই। কীর্তন করা যায়। পুজো দিতে লাইন দিতে হয় না রে ভাই, সব লাইন ছেড়ে ভিতরে আসতে হয়। প্রসাদ হাতে, জিভে পাওয়া যায় না রে ভাই, হৃদয়পুটে কাঙাল হয়ে তার যোগ্য হতে হয়।”
অন্ধ বাউল নিজের মনে বলে যাচ্ছে মায়ের মন্দিরের বাইরে বসে। দুপুর গড়ালো। মন্দির ফাঁকা হল। পূজারী বাউলকে বলল, আজ প্রসাদ নিয়ে যেও গো, মায়ের পুজো আজ। রটন্তী কালীপুজো জানো তো?
বাউল হাসল। বলল, তাই তো সকাল থেকে আজ মায়ের থানে বসে গো। আজ আমার শ্রীরাধা মায়ের রূপ ধরেছিল কুঞ্জে। গোপীরা পুজো করেছিল। রাধাই যে আদ্যাশক্তি সে কথা রটেছিল আজ বলেই না রটন্তী কালীপুজো। প্রসাদ নিয়েই যাব।
দুর্গা পুজোর থালাবাসন ধুয়ে পুকুরপাড় থেকে ফিরছিল। মনটা ভীষণ খারাপ। কেন খারাপ দুর্গা স্পষ্ট করে বুঝতে চাইছে না। বুঝতে গেলে নিজেরই লাগছে। দুর্গা'র গল্পটা বলে নিই সংক্ষেপে। দুর্গা যখন এই চাকদায় আসে, তখন বয়েস কুড়ি ছুঁয়েছে সবে। একটা ছেলেও হয়েছে। লোকের বাড়ি কাজ করে। বর মিস্ত্রীর কাজ করে। তখন তার উপর নজর পড়েছিল অসীমের। অসীমের বয়স তখন পঁচিশের আশেপাশে। মাছের ভেড়ি আছে। দুর্গা ওদের ভেড়ির সামনে দিয়েই দু'বেলা কাজে যায়। দুর্গা'র উপর মন পড়ল অসীমের। যেন পাগল নদী স্থির দীঘি হল অসীমের বুকে এসে। দুর্গাকে দেখলে মনটা ধানকাটা মাঠের মত মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যায়। দুর্গা'র হাসির আওয়াজ কানে এলে মনে হয় সেই ফাঁকা ক্ষেতের উপর এসেছে মৌসুমী মেঘ। বৃষ্টি হবে। ফসল হবে আবার।
দুর্গা সবটা জানে। দু'চক্ষে দেখতে পারে না অসীমকে। কেন তার বাড়ি মা-বোন নেই? এদিকে সেই রাস্তা এড়িয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে যেতেও পারে না এক সপ্তাহের বেশি। বশ করেছে তাকে! বড় পাজি!
গল্পটা এর বেশি না। কিন্তু কাঁটাটা রক্তের সঙ্গে মিশে হৃৎপিণ্ডের এত কাছে লেগেছিল দুর্গা জানল অসীমের হঠাৎ মারা যাওয়ার পর। গতমাসেই। যেন পাকাবাড়ির একটা দেওয়াল খসে গেল। দুর্গা কাঁদেনি। এ কাঁদার শোক নয় তো। বিহ্বল হওয়ার শোক। দুর্গা যত বিহ্বলতা চাপা দিতে যায় তত বাইরে রুক্ষ হয়ে পড়ে। এখন যেমন ঝাঁঝিয়ে উঠল বাউলের কথা শুনে, “ওসব কেচ্ছার কথা রাখো দাদা। সংসার করতে হলে ওসব শোনাও পাপ। তুমি আর কি বুঝবে, বাউণ্ডুলে হয়ে, গেরুয়া দেখিয়ে, বেশ এ মন্দির, সে মন্দির খেয়ে কাটিয়ে দিলে। শখের প্রাণ। গড়ের মাঠ।”
কথাগুলো নিজের কানেও লাগল দুর্গার। বড় কঠিন হয়ে গেল কথাগুলো। পূজারী, নিত্য ভটচায্যিও অবাক হয়ে একবার দুর্গা'র মুখের দিকে, আরেকবার বাউলের মুখের দিকে তাকালো। এ দুর্গাকে সে চেনে না। যাই হোক, পুজোপার্বণের দিনে এতবড় খারাপ কথাটা…..
বাউলের চোখটায় কান্না পেল। দুটো প্রসাদ দেয় বলে এতবড় কথাটা বলে ফেলল? সে না রাধা দেখেছে, না কালী। জন্ম কানা সে। বাবা-মা মরল। ভাইরা খেদালো। বুড়ো বাউল আশ্রমে ঠাঁই দিল। তো সে গুরু দেহ ছাড়ার পর আশ্রমের ভাইয়েরাও বার করে দিল। সেই থেকে সে ভিখারি। সেকি সে জানে না? কোনকালে নিজেকে সাধু বলেছে সে? সুখ বলতে রাধা নাম। গায়। সুখ পায়। কেন পায় তলিয়ে দেখেনি কোনোদিন। সুখ পায় এতে তো কোনো ফাঁকি নেই। তার বুদ্ধিতে যতই ফাঁক থাকুক না কেন।
বাউল বলল, দিদি তোমার কথা সত্যি। কিন্তু সেকি আর কেচ্ছা গো দিদি। গুরু বলতেন, রাধা মানে আমার বুকের মধ্যে ওড়ার সাধ, আর আকাশ মানে কৃষ্ণ, আমার ওড়ার আকাশ। বাধা আমার বাসনা। বাসনাই জটিলাকুটিলা। তাকে তাড়ালেই পাখি গিয়ে আকাশে মেলে। মাঝে মাঝে নীড়ে ফেরে। সে নীড় হল সাধুসঙ্গ। একি খুব মিছে কথা গো দিদি? তোমার ওড়ার সাধ হয় না?
দুর্গা'র মনে যেটুকু অনুতাপ জন্মায় ক্ষোভের আগুনে পুড়ে যায়। আরো রুক্ষ হয়। আরো ঝাঁঝিয়ে যায়। সে বলল, না দাদা, আমার ছেলেমেয়ে মানুষ করতেই চুলে পাক ধরল, শরীর দড়ি দড়ি হল। ও শখ তোমাদের মত মানুষের। আমাদের এই খাঁচাতেই সুখ।
বাউল বলল, তাই হোক দিদি। তোমার সোনার খাঁচা হোক।
দুর্গা'র বুকে বিঁধল কথাটা। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। বাসনকোসন নিয়ে মায়ের সামনে বসে সাজাতে সাজাতে গজগজ করতে লাগল। কিন্তু বেশিক্ষণ না। হঠাৎ বাইরে শুনল এক মহিলা কণ্ঠ। বাউলকে বলছে কেউ কীর্তনের কথা। কে জানে দুর্গা। অসীমের বউ। লতিকা। চোখ ফেটে জল এলো দুর্গা'র। বাউলকেও চাই তার! কেন, কেন সব নেবে সে?
দুর্গা আঁচলে চোখ মুছে মায়ের দিকে তাকালো। মা নিজেই রাধা? এই যে পায়ের তলায় শিব। একে ফেলে যাবে কুঞ্জে আজ? শ্রীকৃষ্ণের কাছে? পাপ হবে না? তাত্ত্বিক বলে হরি আর হরে কোনো ভেদ নেই। কিন্তু মেয়েমানুষের মন বোঝে অত তত্ত্ব? মা, তোমার লজ্জা লাগবে না? মা তুমিই রাধা হয়ে যাবে?
দুর্গা বাইরে এলো। বাউল প্রসাদ পেতে পেতে তার আসার শব্দ শুনে থামল। বলল, কে, দিদি?
দুর্গা'র আবার কান্না পেল। এত অসহায় মানুষ একটা। একে এত কিছু বলল? ছি ছি! তার কি হল, সে বাউলের পাশে বসে বলল, আমায় ক্ষমা করো দাদা, মাথা ঠিক ছিল না, কি বলতে কি বলে ফেলেছি….
বাউল বলল, তুমি মা আমার…. তোমার কথা ধরলে চলে….
দুর্গা স্তব্ধ হয়ে গেল। তাই তো। সে তো মা-ও। দুটো সন্তানকে ফাঁকি দিয়ে মানুষ তো করেনি। এই অন্ধ বাউলকে দেখে তার যে মায়া, সে তো মায়েরই মায়া। আবার এই বুকেই অসীমের জন্যে যে কাঁটা!
সব গুলিয়ে গেল দুর্গা'র। আবার মন্দিরে গেল। মায়ের সামনে থেকে দুটো মিষ্টি নিল, বলল, মা বুঝেছি। বাইরে এসে বাউলের পাতে দিয়ে বলল, মায়ের প্রসাদ। দুটো সন্দেশ দিলাম দাদা। খেও।
বাউল বলল, তোমার নূপুরের আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছিল দিদি, আমার শ্রীমতী যাচ্ছেন অভিসারে….
দুর্গা হেসে বলল, আমি আর কার কাছে যাব ভাই অভিসারে? তিনি এখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন ঘরে।
বাউল বলল, অভিসার কি দিদি শুধু বাইরেই…. ভিতরের মানুষের সঙ্গে কি হয় না দিদি অভিসার? সবারই এক ভিতরের মানুষ থাকে দিদি। তার নাম নিতে নেই মুখে। প্রাণে তার নামের শিখায় আলো করে থাকে হৃদয়।
থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল দুর্গা। এ কথাটা সেও তো জানে। বাউলও জানে!